মা, আজকে তোমার পৃথিবীতে আসার তৃতীয় দিন হলো। তোমার আগমনে আমি একদিকে আনন্দ অন্যদিকে আবার বিমর্ষ। তোমায় এখনও ছুঁয়ে দেখা হয়নি, কোলে নেয়া হয়নি, আদর করা হয়নি। নানাবিধ কারণে বাস্তবিক জটিলতায় আমি আবদ্ধ হয়ে আছি। শিকল ছিড়ে বের হবো নিশ্চয়ই, সব সময়েই টান আসার পর। সেই অপেক্ষায়।
তোমার আগমনের এই তৃতীয় দিনে অনেক ঘটনার টালমাটালে একটা ঘটনা মনে পড়লো। সকাল থেকে সময়ের সাথে সাথে যেন চোখের সামনে ভাসছে সেই ঘটনা। স্মৃতির প্রতারণা, স্মৃতির তামাশা বড়ই রহস্যময় ও অপ্রাকৃতিক।
২০১৭ সালে মা যখন মারা গেলো। তখন তৃতীয় সকাল সকাল আব্বুর সাথে গেলাম বাজারে। বাজার সদাই করলাম। বাসায় এসে সেসব গেলো কাটাকাটির জন্য। চাচীরা বটিবাটি নিয়ে বসে গেলো। রাঁধুনির জন্য চুলা তৈরি করা হলো ছাদে। ঘন্টাখানেক পর চুলায় আগুন জ্বলল। শুনেছিলাম মৃতের ঘরে নাকি আগুন জ্বালানো যায় না কয়েকদিন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে বানানো চুলার ব্যাপারে হয়তো নিয়ম আলাদা আছে কি না জানা নেই। রান্না হচ্ছে, নানারকম ডাকাডাকি, বড় হাঁড়িতে, বড় বড় চামুচ নাড়ানোর শব্দ, বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লিতে বাড়িটা মুখোমুখি। দুইদিন আগেই যে এই বাড়িতে একজন মারা গেছে বোঝার কোন উপায় নেই। সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে। মৃতের শোক কাটিয়ে সামাজিকভাবে তৈরি ধর্মীয় অনুশাসন পালনের করতেই হবে । (যদিও ইসলাম ধর্মে মৃতের জন্য অনুষ্ঠান নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কেউ বলে জায়েজ, কেউ বলে না করা ভালো। কিন্তু সমাজ বলেছে করতে হবে, তাই করতেই হবে।) রান্না শেষেই একদল খাবার পরিবেশনে লেগে গেলো সবাই। আমার সামনেও রাখা হলো এক প্লেট খিচুড়ি, গরুর মাংস, সালাত। ধোয়া ওঠা প্লেটের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম – মায়ের মৃত্যুর আজ তিনদিন, জীবনের নিষ্ঠুর নিয়মে সামাজিক বাধ্যবাধকতা। যে সমাজ আমার মায়ের সুখ-দুখের ভাগ কোনদিন নিলো না, সেই সমাজ আমার মায়ের মৃত্যুর পর কত নিয়ম মানাতে বাধ্য করছে। মা-হারা সন্তানকে শোক থেকে মুক্তির পথ না দেখিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে বাজার পাঠিয়ে দিচ্ছে। সমাজের বাস্তবতা।
সেদিন আমি বুঝেছিলাম, সমাজ কখনও মানুষের জন্য হবার নয়। কথাও ছিলো না। বরং মানুষ সমাজের জন্য হবার কথা ছিলো। মানুষ ছাড়া সমাজের অস্তিত্ব নেই তবুও সমাজ বসে আছে মানুষের মাথায়।
সমাজের দোহাই দিয়ে একজন আরেকজনের মাথায় বসে থাকে, ইমোশনাল পলিটিক্স ব্যবহার করে, সম্পর্কে আবদ্ধ করে। কিন্তু কেউ কারোও কষ্টের ভাগ নেয় না। বরং কষ্টের সময় সমাজ আনন্দ চায়। সমাজ উল্লাসিত হতে চায়।
মা, তুমি যখন বড় হবে, তখন তুমি মানুষ হবে। সামাজিক মানুষ হবার চেয়ে, একজন সত্যিকারের মানুষ হবে। তবে আবেগী হবে না। আমার ব্যাপারেও না। একটা সময় তুমি বুঝবে, আবেগ আমাদের দূর্বলতা বাড়ায়, আমার প্রসারিত পথকে সংকুচিত করে। তারপর আমাদের পথচলা দেখে অট্টহাসি হাসে, নাক ছিটকায়। সমাজ কি বললো, এসব ভাববে না কখনও। কারণ তুমিই সমাজ।