তাসলিমুল হাসান সিয়াম: চোর ও ছিনতাইকারীদের দৌড়াত্ন বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমেই অনিরাপদ জনপদে পরিণত হয়েছে গাইবান্ধা। নানা কৌশলে চলমান ছিনতাই, চুরির ঘটনা যেন নিত্যদিনের। কখনো অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই, কখনো মলমপার্টি, শয়তানের নিঃশ্বাস দিয়ে ভুক্তভোগীকে কাবু করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব। দিন দিন এমন ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ তৎপরতা না থাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে চোর ও ছিনতাইকারীর একাধিক শক্তিশালী চক্র। এসব চক্রের বেশির ভাগ সদস্য উঠতি বয়সের তরুণ। চুরি-ছিনতাইয়ের অপকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে ধারালো অস্ত্র ও চেতনানাশক ওষুধ।
পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ানক যে বাসা বাড়িতে রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় থেকে শুরু করে গ্যারেজে রাখা সাইকেল,মোটর সাইকেল কোন কিছুই রেহাই পাচ্ছে না চোরের হাত থেকে। এদিকে চুরির পাশাপাশি সমান তালে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা । তবে অধিকাংশ চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা থানার খাতায় এন্ট্রি করা হয় না পুলিশি হয়রানির ভয়ে । আর চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধার হবে না জেনে কেউ কেউ পুলিশকে এড়িয়ে চলেন।
সম্প্রতি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনজন ব্যক্তি প্রাণ হারান । তারা উভয়েই অটো রিকশা ও ভ্যান চালক ছিলেন বলে স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে।
জানা গেছে গত ২৪ শে এপ্রিল দিবাগত রাতে আনিস মিয়া নামের এক অটো রিকশা চালক শহরের ২নং রেলগেট এলাকায় কয়েকজন অপরিচিত যাত্রীকে নিয়ে শহরের স্টেডিয়ামমুখী হন। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দুর্বৃত্তরা তাকে অটোবাইকের চাবি দিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তখনই তারা ছুরি বের করে তার পেটে এলোপাতাড়ি আঘাত করে এবং অটোবাইক ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ৫ মে গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার বোনাড়পাড়ায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এক কিশোরকে । পরে পুলিশ অজ্ঞাত হিসেবে ঐ কিশোরকে প্রথমে সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায় । এর আহত ঐ কিশোরের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে তার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় । ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সদর উপজেলার দক্ষিণ ধানঘড়া গ্রামের আন্তাজ আলীর ছেলে নবম শ্রেণীর ছাত্র হামিম রহমান জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য ৪ মে রাত নয়টার দিকে বাসা থেকে ইজিবাইক নিয়ে বের হয় । এরপর অজ্ঞাত পরিচয়ের কিছু ব্যক্তি তার রিকশায় ওঠে এরপর থেকেই তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
একই রকম অন্য আরেক ঘটনায় প্রাণ হারান আলেফ উদ্দিন (৫৫) নামের আরেক ভ্যানচালক।ঘটনার বিবরণে জানা যায় ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিন যাত্রী নিয়ে সদর উপজেলার বালুয়া থেকে অটো ভ্যান নিয়ে তিনি পলাশবাড়ির উপজেলা শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে পলাশবাড়ি উপজেলার মাঠেরহাট এলাকায় তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ধান খেতে ফেলে রেখে হত্যাকারীরা তাঁর ভ্যানটি নিয়ে পালিয়ে যায়।
শহরবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে,
রাত হলেই অনেক সড়ক এড়িয়ে চলতে হয় পথচারীদের। যেমন শহরের স্কুল লেন, আদর্শ কলেজ সড়ক, স্টেডিয়ামের আশেপাশের এলাকা, খন্দকার মোড়, পূর্বপাড়া, রেলস্টেশনসহ বেশ কিছু এলাকা দিয়ে রাতে মানুষের যাতায়াত কমে যায়। কারণ সন্ধ্যা হলেই এসব এলাকায় মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়।
গাইবান্ধা শহরের বাংলা বাজার এলাকার বাসিন্দা রফিকুল আমিন বলেন , গত ৩ মে রাত সাড়ে আটটার দিকে পূর্ব পাড়া এলাকায় আমি ও আমার স্ত্রী রিকশায় যাচ্ছিলাম পথিমধ্যে একটি মোটরসাইকেলে দুইজন যুবক আমার স্ত্রীর হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
গাইবান্ধা শহরের কলেজ পাড়া এলাকার সবুজ রহমান বলেন, কিছু দিন আগে আমার বাসা থেকে ভাড়াটিয়াদের রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় চুরি হয়েছে বিষয়টি খুবই বিব্রতকর ছিলো । সিসিটিভি ফুটেজে দেখলাম মধ্যবয়সী চোরটি মুখে মাস্ক পড়ে সুযোগ বুঝে বাসায় ঢুকে কাপড় চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আফরোজা লুপু বলেন, “চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, এটি সমাজের গভীর সংকটের প্রতিফলন। বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও মাদকাসক্তি অনেককে অপরাধের পথে ঠেলে দিচ্ছে।”যতক্ষণ না পর্যন্ত অর্থনৈতিক অসমতা ও যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, ততক্ষণ অপরাধ রোধ সম্ভব নয়। সরকারকে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে।”তিনি আরও উল্লেখ করেন “চুরি বা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে অনেক সময় বিচার বিলম্বিত হয়। এতে অপরাধীরা সাহস পায়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও কঠোর শাস্তি অপরাধ রোধে সহায়ক হতে পারে।”
তবে গাইবান্ধা জেলার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশ সুপারসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি ।