বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যে ভোরে সূর্য ওঠে হৃদয়ে

 

বিমল সরকার

(“কালের চিঠি” সিরিজ থেকে)

 

ভোর মানে শুধু আলোর আগমন নয়,

ভোর মানে আত্মার পুনর্জন্ম।

যে মানুষ নিজের ভেতরের অন্ধকার ভেঙে

আলো খোঁজে,

তার প্রতিটি সকালই হয় অনন্তের পাঠ।

– বিমল সরকার

দৃশ্য ১ : কুয়াশার মধ্যে প্রথম আলো

(স্থান: বালাসীঘাট, আদি ব্রহ্মপুত্র তীর)

ভোর সাড়ে তিনটা।শীতের কুয়াশা তখন ব্রহ্মপুত্রের জলে নেমে এসেছে।চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোনো হাঁসের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।

কিশোর শঙ্কর মশারিবিহীন শক্ত খাট থেকে উঠে বসেছে।মাটির ঘরে ক্ষীণ লন্ঠনের আলো, বই খোলা, পাশে এক গামছা।হাতে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, আর ডেল কার্নেগি।মায়ের মৃদু গলা শোনা যায়-

“এত ভোরে উঠে বসিস কেন বাবা? একটু বিশ্রাম নে।”

শঙ্কর হেসে বলে-

“যে ভোরে সূর্য ওঠে হৃদয়ে,সেই ভোরে ঘুমালে

আলো মিস হয়ে যায় মা।”

বাইরে তখন আদি ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে আলো ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে।

 

দৃশ্য ২ : টুলু চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ ও অনুপ্রেরণা

(স্থান: বড়ডাঙ্গার বিলের রাস্তা)

ভোরের আলোয় শঙ্কর বই হাতে হাঁটছে স্কুলের দিকে। হঠাৎ পাশে সাইকেলে আসছেন টুলু চেয়ারম্যান-

যুবক, হাসিখুশি, এলাকার সবাই তাকে “চেয়ারম্যান ভাই” বলে ডাকে।

শঙ্কর দেখে থেমে বলেন-

“তুই আবার ভোরে বই নিয়ে রাস্তায়?

পাগল নাকি? ঠান্ডায় জমে যাবি।”

শঙ্কর হাসে, বলে-

“চেয়ারম্যান ভাই, শরীর ঠান্ডায় জমে না,

স্বপ্ন জমে গেলে জীবন থেমে যায়।”

টুলু মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠেন-

“তুই বইয়ের পাগল, কিন্তু তোর এই পাগলামিই

একদিন তুলসীঘাটে আলো জ্বালাবে।”

সেই বাক্য বিমলের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।

 

দৃশ্য ৩ : নিজাম চেয়ারম্যান দাদু ও জীবনের পাঠ

(স্থান: মীরপুর বাজার)

নিজাম চেয়ারম্যান দাদু, যিনি জীবনে তিনবার নির্বাচনে পরাজিত, কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ। শঙ্কর একদিন জিজ্ঞেস করে-

“দাদু, আপনি বারবার হারেন, কষ্ট হয় না?”

নিজাম সাহেব হেসে বলেন-

“হার মানে পরাজয় নয় রে,

হার মানে সময়ের পাঠ শেখা।

বিজয় সাময়িক, কিন্তু ধৈর্য চিরকাল টিকে থাকে।”

শঙ্কর তার চোখে দেখেছিল শান্তি ।এক পরাজিত মানুষ, যিনি আসলে জয় করেছেন সময়কে।

 

দৃশ্য ৪ : বন্ধুত্বের প্রভাত – নদীর তীরে পাঁচজন

(স্থান: আদি ব্রহ্মপুত্রের ঘাট)

সেই ভোরের সময়—

সঞ্জয়, আরিফুল, আশীষ, বিদ্যুৎ, আর শঙ্কর—পাঁচজন বন্ধু নদীর ধারে বসে গল্প করছে।

সঞ্জয় বলে,

“তুই সবসময় বই পড়িস, খেলবি না?”

শঙ্কর বলে-

“আমি আলো নিয়ে খেলি।”

আরিফুল হাসে,

“তুই না রে একদিন মানুষ হয়ে যাস!”

শঙ্কর উত্তর দেয়—

“মানুষ হতে চাই, কিন্তু নিজের মধ্যে আলো নিয়ে।”

সবাই একসাথে নদীতে নেমে পড়ে—

শীতের জলে সাঁতার কাটতে কাটতে হাসির তরঙ্গ ভেসে যায় আদি ব্রহ্মপুত্রের ওপারে।

 

দৃশ্য ৫ : হার মানা রাত, জেগে থাকা আলো

(স্থান: খামার পীরগাছার ঘর)

রাত গভীর। কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে।লন্ঠনের আলো নিভে যাচ্ছে। শঙ্কর কাগজে লিখে রাখে-

“হে আলো, নিভিও না আমার ভিতরে।

এই অন্ধকার একদিন বই হয়ে জ্বালবে পৃথিবী।”

তখনই দূরে মায়ের কণ্ঠ—

“খেয়ে নিস রে বাবা, না খেলে কবিতা চলে না।”

শঙ্কর চুপ করে থাকে, চোখে এক অনন্ত প্রতিজ্ঞা-

জীবন তাকে হারাতে পারবে না।

 

দৃশ্য ৬ : তুলসীঘাটের পাঠাগার – পুনর্জন্মের সকাল

(স্থান: তুলসীঘাট, বহু বছর পরে)

আজ সেখানে “বিমল সরকার সাহিত্য সম্ভার ও পাঠাগার”-এর বর্ষপূর্তি।বাচ্চারা বসেছে বই হাতে, মুখে হাসি।

শঙ্কর এখন টেক্সাসে বসে পাঠাচ্ছেন সেই চিঠি-

“ভোরের আলোয় যখন আদি ব্রহ্মপুত্রের ওপারে কুয়াশা ঝুলে থাকে,আমি তখনও অনুভব করি তোমাদের নিঃশব্দ উপস্থিতি।

বই মানে মলাট নয়, বই মানে- অন্ধকার থেকে আলোর দিকে হাঁটা।”

দূরে আদি ব্রহ্মপুত্রের জলে ভেসে ওঠে সূর্যের প্রতিচ্ছবি যেন পৃথিবীর হৃদয়ে আবার সূর্য উঠেছে।

 

দৃশ্য ৭ : কালের চিঠির কবিতা – “ভোরের উত্তরাধিকার”

কুয়াশার ভিতর জেগেছিল এক কিশোর,

হাতে বই, চোখে আগুন।

লন্ঠনের আলোয় লেখা তার সময়,

আজ সে জ্বলে পৃথিবীর অক্ষরজুড়ে।

যে ভোরে সূর্য ওঠে হৃদয়ে,

সে ভোরে মানুষ হয়ে ওঠে সভ্যতা।

বালাসীঘাটের জলে,

খামার পীরগাছার মাটিতে,

সেই আলোর সন্তান আজও হাঁটে

নতুন প্রজন্মের চোখে,

নতুন ইতিহাসের পথে।

জনপ্রিয়

ইউথ ক্লাইমেট স্মল গ্র্যান্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল সৃজনশীল গাইবান্ধা  

যে ভোরে সূর্য ওঠে হৃদয়ে

প্রকাশের সময়: ০৩:০৪:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫

 

বিমল সরকার

(“কালের চিঠি” সিরিজ থেকে)

 

ভোর মানে শুধু আলোর আগমন নয়,

ভোর মানে আত্মার পুনর্জন্ম।

যে মানুষ নিজের ভেতরের অন্ধকার ভেঙে

আলো খোঁজে,

তার প্রতিটি সকালই হয় অনন্তের পাঠ।

– বিমল সরকার

দৃশ্য ১ : কুয়াশার মধ্যে প্রথম আলো

(স্থান: বালাসীঘাট, আদি ব্রহ্মপুত্র তীর)

ভোর সাড়ে তিনটা।শীতের কুয়াশা তখন ব্রহ্মপুত্রের জলে নেমে এসেছে।চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোনো হাঁসের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।

কিশোর শঙ্কর মশারিবিহীন শক্ত খাট থেকে উঠে বসেছে।মাটির ঘরে ক্ষীণ লন্ঠনের আলো, বই খোলা, পাশে এক গামছা।হাতে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, আর ডেল কার্নেগি।মায়ের মৃদু গলা শোনা যায়-

“এত ভোরে উঠে বসিস কেন বাবা? একটু বিশ্রাম নে।”

শঙ্কর হেসে বলে-

“যে ভোরে সূর্য ওঠে হৃদয়ে,সেই ভোরে ঘুমালে

আলো মিস হয়ে যায় মা।”

বাইরে তখন আদি ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে আলো ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে।

 

দৃশ্য ২ : টুলু চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ ও অনুপ্রেরণা

(স্থান: বড়ডাঙ্গার বিলের রাস্তা)

ভোরের আলোয় শঙ্কর বই হাতে হাঁটছে স্কুলের দিকে। হঠাৎ পাশে সাইকেলে আসছেন টুলু চেয়ারম্যান-

যুবক, হাসিখুশি, এলাকার সবাই তাকে “চেয়ারম্যান ভাই” বলে ডাকে।

শঙ্কর দেখে থেমে বলেন-

“তুই আবার ভোরে বই নিয়ে রাস্তায়?

পাগল নাকি? ঠান্ডায় জমে যাবি।”

শঙ্কর হাসে, বলে-

“চেয়ারম্যান ভাই, শরীর ঠান্ডায় জমে না,

স্বপ্ন জমে গেলে জীবন থেমে যায়।”

টুলু মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠেন-

“তুই বইয়ের পাগল, কিন্তু তোর এই পাগলামিই

একদিন তুলসীঘাটে আলো জ্বালাবে।”

সেই বাক্য বিমলের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।

 

দৃশ্য ৩ : নিজাম চেয়ারম্যান দাদু ও জীবনের পাঠ

(স্থান: মীরপুর বাজার)

নিজাম চেয়ারম্যান দাদু, যিনি জীবনে তিনবার নির্বাচনে পরাজিত, কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ। শঙ্কর একদিন জিজ্ঞেস করে-

“দাদু, আপনি বারবার হারেন, কষ্ট হয় না?”

নিজাম সাহেব হেসে বলেন-

“হার মানে পরাজয় নয় রে,

হার মানে সময়ের পাঠ শেখা।

বিজয় সাময়িক, কিন্তু ধৈর্য চিরকাল টিকে থাকে।”

শঙ্কর তার চোখে দেখেছিল শান্তি ।এক পরাজিত মানুষ, যিনি আসলে জয় করেছেন সময়কে।

 

দৃশ্য ৪ : বন্ধুত্বের প্রভাত – নদীর তীরে পাঁচজন

(স্থান: আদি ব্রহ্মপুত্রের ঘাট)

সেই ভোরের সময়—

সঞ্জয়, আরিফুল, আশীষ, বিদ্যুৎ, আর শঙ্কর—পাঁচজন বন্ধু নদীর ধারে বসে গল্প করছে।

সঞ্জয় বলে,

“তুই সবসময় বই পড়িস, খেলবি না?”

শঙ্কর বলে-

“আমি আলো নিয়ে খেলি।”

আরিফুল হাসে,

“তুই না রে একদিন মানুষ হয়ে যাস!”

শঙ্কর উত্তর দেয়—

“মানুষ হতে চাই, কিন্তু নিজের মধ্যে আলো নিয়ে।”

সবাই একসাথে নদীতে নেমে পড়ে—

শীতের জলে সাঁতার কাটতে কাটতে হাসির তরঙ্গ ভেসে যায় আদি ব্রহ্মপুত্রের ওপারে।

 

দৃশ্য ৫ : হার মানা রাত, জেগে থাকা আলো

(স্থান: খামার পীরগাছার ঘর)

রাত গভীর। কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে।লন্ঠনের আলো নিভে যাচ্ছে। শঙ্কর কাগজে লিখে রাখে-

“হে আলো, নিভিও না আমার ভিতরে।

এই অন্ধকার একদিন বই হয়ে জ্বালবে পৃথিবী।”

তখনই দূরে মায়ের কণ্ঠ—

“খেয়ে নিস রে বাবা, না খেলে কবিতা চলে না।”

শঙ্কর চুপ করে থাকে, চোখে এক অনন্ত প্রতিজ্ঞা-

জীবন তাকে হারাতে পারবে না।

 

দৃশ্য ৬ : তুলসীঘাটের পাঠাগার – পুনর্জন্মের সকাল

(স্থান: তুলসীঘাট, বহু বছর পরে)

আজ সেখানে “বিমল সরকার সাহিত্য সম্ভার ও পাঠাগার”-এর বর্ষপূর্তি।বাচ্চারা বসেছে বই হাতে, মুখে হাসি।

শঙ্কর এখন টেক্সাসে বসে পাঠাচ্ছেন সেই চিঠি-

“ভোরের আলোয় যখন আদি ব্রহ্মপুত্রের ওপারে কুয়াশা ঝুলে থাকে,আমি তখনও অনুভব করি তোমাদের নিঃশব্দ উপস্থিতি।

বই মানে মলাট নয়, বই মানে- অন্ধকার থেকে আলোর দিকে হাঁটা।”

দূরে আদি ব্রহ্মপুত্রের জলে ভেসে ওঠে সূর্যের প্রতিচ্ছবি যেন পৃথিবীর হৃদয়ে আবার সূর্য উঠেছে।

 

দৃশ্য ৭ : কালের চিঠির কবিতা – “ভোরের উত্তরাধিকার”

কুয়াশার ভিতর জেগেছিল এক কিশোর,

হাতে বই, চোখে আগুন।

লন্ঠনের আলোয় লেখা তার সময়,

আজ সে জ্বলে পৃথিবীর অক্ষরজুড়ে।

যে ভোরে সূর্য ওঠে হৃদয়ে,

সে ভোরে মানুষ হয়ে ওঠে সভ্যতা।

বালাসীঘাটের জলে,

খামার পীরগাছার মাটিতে,

সেই আলোর সন্তান আজও হাঁটে

নতুন প্রজন্মের চোখে,

নতুন ইতিহাসের পথে।