বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাদাম ডাকাতি- বিমল সরকার

গাইবান্ধার হাটে- বাজারে
ঠেলাগাড়ি ঠেলে এক মানুষ,
হাতে বাদাম, চোখে চড়া রোদ,
যার কাঁধ থেকে ঝরে পড়ে নুনের মতো ঘাম
রমিজ মিয়া তার নাম ।
একটা বাদাম অনুমতিগীন মুখে তুলে
তুমি যদি বলো-“টেস্ট করলাম”,
সেই মুহূর্তের ব্যথা বোঝ কি তুমি
একটু ক্ষুধায় একটুকরো দান,
ভেঙে দিতে পারে এক দরিদ্র পরাণ !
তুমি হাসো, চলে যাও চুপে-
কিন্তু তোমার পিছনে চেয়ে থাকে একজোড়া চোখ,
যে চোখে জমে থাকে প্রশ্ন,
বুকের ভেতর গুমরে ওঠে বেদনার শোক-
“ওরে ভাই, আর কতবার খাওয়াবো এভাবে,
কতবার গুনবো ক্ষতির অঙ্কটা গোপনে?”
তোমার কাছে হয়তো
একটা বাদাম মানে কিছুই নয়,
কিন্তু তার সন্তানের মুখে
সেই বাদামই-সন্ধ্যার একমাত্র সঞ্চয়!
ক্ষতির অঙ্কটা ছোট্ট,
তবু জমে জমে পাহাড় হয়ে যায়,
যেখানে পিছিয়ে পড়ে দুধের দাম,
থেমে থাকে চোখের জল,
ভেঙে পড়ে জীবনের বাঁধ।
বিবেক আজ জাগে না
শহুরে বুকের ভেতর,
নিয়মহারা শহুরে সমাজ
আত্মাকে গলায়
যাদের পরিধানে অন্ধ সভ্যতার চুরি করা বস্ত্র!
একটু চুরি,একটুকরো মিথ্যা,
কিংবা অভিনয় করা হাসি-
গড়ে তোলে এক বেদনার বালুচর,
যেখানে বাদামের খোসায়ও
লুকিয়ে থাকে সংসারের শেষ প্রহর।
হে পথচারি ! একটু থামো !
ভেবো না কেবল স্বাদের বিস্ময়ে,
যে ঠেলাগাড়ি ঠেলে যায় রমিজ-
তার যাত্রা যে থেমে যায়
ক্লান্তির অভিশয়ে !
ছোট্ট একটা বাদাম-
তুমি খেয়েছো হয়তো খেলাচ্ছলে,
তবু তার পিছনে ঝরে পড়ে
রমিজের কপালের নোনতা ঘাম!
ভালোবাসা মানে শুধু হারানো নয়—
অন্যের ঘামকেও সম্মান জানানো ।
কবির আত্মবোধ
এই কবিতা যেন বিবেকের আঙিনায় একটি টোকা।
বস্তুত, এটি কেবল রমিজ মিয়ার নয়,সব রমিজদের কথা- যারা হাসে, কাঁদে, সহ্য করে,আর আমাদের ছোট্ট ‘টেস্ট’-এ তাদের সংসারের ভাতের হিসাব
প্রেক্ষাপট
গাইবান্ধার তুলসীঘাট এলাকার একটি হাট গ্রামবাংলার এক চেনা দৃশ্য। সেখানে ঠেলাগাড়ি নিয়ে বাদাম বিক্রি করেন রমিজ মিয়া। এই মানুষটি প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে, তার সামান্য পুঁজির উপর ভর করে চলে একটি সংসার । কিন্তু শহরের শিক্ষিত, তথাকথিত ‘সভ্য’ কিছু মানুষ “একটু টেস্ট করলাম” বলে, বিনা মূল্যে এক বা একাধিক বাদাম খেয়ে যান। তারা হয়তো বুঝতেই পারেন না-এই ছোট একটি ‘খাওয়া’ কখনো কখনো একটি পরিবারের আহার কেড়ে নিতে পারে। এই কবিতা সেই নৈমিত্তিক অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি।
কবির অনুভূতিঃ
আমার দৈনিক কালের চিঠির স্থানীয় সাংবাদিক শামছুর রহমান হৃদয়ের চোখে গাইবান্ধার হাটে দাঁড়িয়ে,আমি দেখেছি -এক অচেনা মানুষের চোখের বিষন্নতা , ক্লান্তি, আর নীরব এক প্রশ্ন। আমি শুনেছি, কোনো প্রতিবাদ না করেও যে মানুষ প্রতিবাদ করে-তাকে বলে রমিজ মিয়া। এই কবিতা সেই একফোঁটা ঘামের সম্মান রক্ষার প্রার্থনা।”
রিভিউঃ
কবিতাটি সহজ, প্রাঞ্জল, কিন্তু বহুমাত্রিক। এর প্রতিটি স্তবক যেন একেকটি দৃশ্যপট-দেখা যায় হাট, ঠেলাগাড়ি, বাদাম, রমিজের চোখে রোদ। সহজ বাক্য গুলোই গভীর আঘাত হানে পাঠকের মনে।কবিতাটির চিত্রকল্পে একটা বাদাম মুখে তুলে ,ওরা বলে ‘টেস্ট করলাম’” -এই লাইনটি আমাদের ভেতরের চোরকে তুলে ধরে।এক চিমটি চুরি, একটু মিথ্যা দিয়ে তৈরী হয় ছোট ছোট বেদনা” -এখানে কবি চমৎকারভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের গন্ধ ছড়িয়ে দেন, যা রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা সামাজিক ক্ষতকে চিনিয়ে দেয়।
কবিতাটির প্রভাব:
পাঠকের মনে এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম দেয় এই কবিতা। নিজেকে প্রশ্ন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে-আমরা কী সত্যিই সৎ? আমরা কী জানি, একটি ছোট আচরণ কারও জীবনে কত বড় প্রভাব ফেলে?
দার্শনিক প্রতিফলনঃ
এই কবিতা একধরনের আচারবিচার ও নৈতিকতার ক্ষুদ্র দর্শন। সমাজের ক্ষুদ্রতম মুহূর্ত-যেমন একটি বাদাম খাওয়া- এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে চেতনাবোধের পরীক্ষার ক্ষেত্র।বিবেক এখানে পুঁজি;রমিজ মিয়া হলেন প্রতিদিন হারতে হারতে মাথা উঁচু রাখার প্রতীক;টেস্ট করা হল অনৈতিক আচরণের চুনকাম করা ভাষা এবং ঠেলাগাড়ি হল জীবনসংগ্রামের চলমান প্রতীক।এই কবিতা বলে দেয়-সভ্যতা কেবল আধুনিকতা নয়, এটি বিবেকের দায়ও। এক ফোঁটা ঘামের দাম না দিতে পারলে আমরা কেবল মানব রূপধারী প্রাণী হয়ে থাকি-মানবতাবোধবর্জিত।
পরিশেষে,
“বাদাম ডাকাতি “আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়। এটি এক রকম দার্শনিক মানবিকতা-যেখানে প্রাত্যহিক জীবনের নিঃশব্দ বঞ্চনাগুলি উঠে আসে কবিতার ক্যানভাসে। এই কবিতা শুধু পাঠ করার জন্য নয়-এটি মনে রাখবার কিংবা আত্মজিজ্ঞাসার জন্য ।
্যাগলাইনঃ
“শুধু একটি বাদাম ডাকাটি নয়, তুমি জুড়ে নাও আগামীর ঘাম-যা একটি সংসারের আয়ু কমায় !”
জনপ্রিয়

জাতীয় সংসদ নির্বাচন : নির্বাচনী প্রচারণা শুরু ২২ জানুয়ারি

বাদাম ডাকাতি- বিমল সরকার

প্রকাশের সময়: ০৪:২১:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫
গাইবান্ধার হাটে- বাজারে
ঠেলাগাড়ি ঠেলে এক মানুষ,
হাতে বাদাম, চোখে চড়া রোদ,
যার কাঁধ থেকে ঝরে পড়ে নুনের মতো ঘাম
রমিজ মিয়া তার নাম ।
একটা বাদাম অনুমতিগীন মুখে তুলে
তুমি যদি বলো-“টেস্ট করলাম”,
সেই মুহূর্তের ব্যথা বোঝ কি তুমি
একটু ক্ষুধায় একটুকরো দান,
ভেঙে দিতে পারে এক দরিদ্র পরাণ !
তুমি হাসো, চলে যাও চুপে-
কিন্তু তোমার পিছনে চেয়ে থাকে একজোড়া চোখ,
যে চোখে জমে থাকে প্রশ্ন,
বুকের ভেতর গুমরে ওঠে বেদনার শোক-
“ওরে ভাই, আর কতবার খাওয়াবো এভাবে,
কতবার গুনবো ক্ষতির অঙ্কটা গোপনে?”
তোমার কাছে হয়তো
একটা বাদাম মানে কিছুই নয়,
কিন্তু তার সন্তানের মুখে
সেই বাদামই-সন্ধ্যার একমাত্র সঞ্চয়!
ক্ষতির অঙ্কটা ছোট্ট,
তবু জমে জমে পাহাড় হয়ে যায়,
যেখানে পিছিয়ে পড়ে দুধের দাম,
থেমে থাকে চোখের জল,
ভেঙে পড়ে জীবনের বাঁধ।
বিবেক আজ জাগে না
শহুরে বুকের ভেতর,
নিয়মহারা শহুরে সমাজ
আত্মাকে গলায়
যাদের পরিধানে অন্ধ সভ্যতার চুরি করা বস্ত্র!
একটু চুরি,একটুকরো মিথ্যা,
কিংবা অভিনয় করা হাসি-
গড়ে তোলে এক বেদনার বালুচর,
যেখানে বাদামের খোসায়ও
লুকিয়ে থাকে সংসারের শেষ প্রহর।
হে পথচারি ! একটু থামো !
ভেবো না কেবল স্বাদের বিস্ময়ে,
যে ঠেলাগাড়ি ঠেলে যায় রমিজ-
তার যাত্রা যে থেমে যায়
ক্লান্তির অভিশয়ে !
ছোট্ট একটা বাদাম-
তুমি খেয়েছো হয়তো খেলাচ্ছলে,
তবু তার পিছনে ঝরে পড়ে
রমিজের কপালের নোনতা ঘাম!
ভালোবাসা মানে শুধু হারানো নয়—
অন্যের ঘামকেও সম্মান জানানো ।
কবির আত্মবোধ
এই কবিতা যেন বিবেকের আঙিনায় একটি টোকা।
বস্তুত, এটি কেবল রমিজ মিয়ার নয়,সব রমিজদের কথা- যারা হাসে, কাঁদে, সহ্য করে,আর আমাদের ছোট্ট ‘টেস্ট’-এ তাদের সংসারের ভাতের হিসাব
প্রেক্ষাপট
গাইবান্ধার তুলসীঘাট এলাকার একটি হাট গ্রামবাংলার এক চেনা দৃশ্য। সেখানে ঠেলাগাড়ি নিয়ে বাদাম বিক্রি করেন রমিজ মিয়া। এই মানুষটি প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে, তার সামান্য পুঁজির উপর ভর করে চলে একটি সংসার । কিন্তু শহরের শিক্ষিত, তথাকথিত ‘সভ্য’ কিছু মানুষ “একটু টেস্ট করলাম” বলে, বিনা মূল্যে এক বা একাধিক বাদাম খেয়ে যান। তারা হয়তো বুঝতেই পারেন না-এই ছোট একটি ‘খাওয়া’ কখনো কখনো একটি পরিবারের আহার কেড়ে নিতে পারে। এই কবিতা সেই নৈমিত্তিক অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি।
কবির অনুভূতিঃ
আমার দৈনিক কালের চিঠির স্থানীয় সাংবাদিক শামছুর রহমান হৃদয়ের চোখে গাইবান্ধার হাটে দাঁড়িয়ে,আমি দেখেছি -এক অচেনা মানুষের চোখের বিষন্নতা , ক্লান্তি, আর নীরব এক প্রশ্ন। আমি শুনেছি, কোনো প্রতিবাদ না করেও যে মানুষ প্রতিবাদ করে-তাকে বলে রমিজ মিয়া। এই কবিতা সেই একফোঁটা ঘামের সম্মান রক্ষার প্রার্থনা।”
রিভিউঃ
কবিতাটি সহজ, প্রাঞ্জল, কিন্তু বহুমাত্রিক। এর প্রতিটি স্তবক যেন একেকটি দৃশ্যপট-দেখা যায় হাট, ঠেলাগাড়ি, বাদাম, রমিজের চোখে রোদ। সহজ বাক্য গুলোই গভীর আঘাত হানে পাঠকের মনে।কবিতাটির চিত্রকল্পে একটা বাদাম মুখে তুলে ,ওরা বলে ‘টেস্ট করলাম’” -এই লাইনটি আমাদের ভেতরের চোরকে তুলে ধরে।এক চিমটি চুরি, একটু মিথ্যা দিয়ে তৈরী হয় ছোট ছোট বেদনা” -এখানে কবি চমৎকারভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের গন্ধ ছড়িয়ে দেন, যা রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা সামাজিক ক্ষতকে চিনিয়ে দেয়।
কবিতাটির প্রভাব:
পাঠকের মনে এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম দেয় এই কবিতা। নিজেকে প্রশ্ন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে-আমরা কী সত্যিই সৎ? আমরা কী জানি, একটি ছোট আচরণ কারও জীবনে কত বড় প্রভাব ফেলে?
দার্শনিক প্রতিফলনঃ
এই কবিতা একধরনের আচারবিচার ও নৈতিকতার ক্ষুদ্র দর্শন। সমাজের ক্ষুদ্রতম মুহূর্ত-যেমন একটি বাদাম খাওয়া- এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে চেতনাবোধের পরীক্ষার ক্ষেত্র।বিবেক এখানে পুঁজি;রমিজ মিয়া হলেন প্রতিদিন হারতে হারতে মাথা উঁচু রাখার প্রতীক;টেস্ট করা হল অনৈতিক আচরণের চুনকাম করা ভাষা এবং ঠেলাগাড়ি হল জীবনসংগ্রামের চলমান প্রতীক।এই কবিতা বলে দেয়-সভ্যতা কেবল আধুনিকতা নয়, এটি বিবেকের দায়ও। এক ফোঁটা ঘামের দাম না দিতে পারলে আমরা কেবল মানব রূপধারী প্রাণী হয়ে থাকি-মানবতাবোধবর্জিত।
পরিশেষে,
“বাদাম ডাকাতি “আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়। এটি এক রকম দার্শনিক মানবিকতা-যেখানে প্রাত্যহিক জীবনের নিঃশব্দ বঞ্চনাগুলি উঠে আসে কবিতার ক্যানভাসে। এই কবিতা শুধু পাঠ করার জন্য নয়-এটি মনে রাখবার কিংবা আত্মজিজ্ঞাসার জন্য ।
্যাগলাইনঃ
“শুধু একটি বাদাম ডাকাটি নয়, তুমি জুড়ে নাও আগামীর ঘাম-যা একটি সংসারের আয়ু কমায় !”