বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শাহানার গল্প – প্রফেসর. হায়দরী আকবর আহমেদ

 

শাহানা বিছানার একপ্রান্তে বসে আছেন। জানালা দিয়ে বিছানার ঠিক মাঝখানে রোদ এসে পড়েছে। শীতের সময় এইখানে তার নাতিটা শুয়ে ঘুমাতো। রোদের হালকা ওম, নাতিদের গায়ের হালকা একটা গন্ধ। শাহানা উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। গেট ঠেলে লোকটা ঢুকলো। তার ছেলের সাথে কথা বলছে। শাহানার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। সমাজের চোখে এই লোকটা তার স্বামী, তার সন্তানদের বাবা। শাহানার কেউ না- কিছুই না।

 

যেদিন জানতে পেরেছিলেন লোকটা আরেকটা বিয়ে করেছে, সেদিন থেকে তার বিবাহিত জীবনের লাশ তার সাথেই আছে। তালাক দেয়ার সাহস বা সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না। বাপের বাড়িতে ফিরে যাবেন- তার উপায়ও নেই। লাশটা তার বুকের মাঝে একাই বয়ে বেড়াতে লাগলেন। লাশটা গলেপঁচে তার সামনেই ছিল। এক সময় তার উপর পোকা পড়লো। দম বন্ধ করা জমাট দুর্গন্ধ আর গলিত কিছু স্মৃতি শুধু তার জন্য রয়ে গেলো। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে একসময় এই লাশ পঁচে গলে কঙ্কাল হলো। এখনো শাহান এই কংকাল বয়ে বেড়ান। কেউ কি তার এই কষ্ট টুকু বুঝতে পেরেছিলো? কেউ না। তিনি যেমন একা, তার কষ্ট গুলোও একা। এই বাড়ি তার ঠিকানা না। এই বাড়িতে তিনি কেন আছেন? তার অসহায় অস্তিত্ব এই বাড়িতে অশরীর ঘুরে বেড়ায়। আসবাব গুলোর ও একটা সংযোগ আছে – এই বাড়ির সাথে। তার নেই। শাহানা কেউ না।

 

বারান্দায় এক কোণে রাখা চেয়ার তার প্রিয় জায়গা। এই জায়গায় বসে শাহানা রোজ একটু আড়াল খোঁজেন। তার একান্ত আপন -নির্জনতা। রাস্তার মানুষ দেখেন। অপেক্ষা করেন -কিসের? তাও জানেন না। এক মেঘলা দুপুরে তার সন্তানদের নিয়ে এই বারান্দায় বসে ছিলেন। হাত ব্যাগে কিছুই ছিল না । তার অস্তিত্বের মতোই ফাঁকা। রিকশা করে বাপের বাড়ি যাবেন, মা তখন বেঁচে ছিলেন। রিকশা ভাড়াটাও ছিল না। এই বারান্দা থেকে রিকশা ডেকে গিয়েছিলেন – বাপের বাড়ি। তার বোন রেহানা এসেছিলো বিদেশ থেকে। রিকশার ভাড়াটা ওই মিটিয়ে দিয়েছিলো। বাড়িতে ঢুকে রেহানা আর মায়ের পাশে বসে অঝোরে কেঁদেছিলেন। তার দোষ ছিলোনা। কোনো অপরাধ করেননি শাহানা। তার সন্তানদের বাবা সবাইকে ফেলে চলে গেলো – ঘর বাধলো – নতুন সংসার। শাহানা পড়ে রইলেন তার সংসার নামের মৃতদেহ নিয়ে- একা।

 

২.

তার ছেলে প্রথম বিয়ের দুটো সন্তান। নাতিদের জন্মের পর একটা পরিচয় পেয়েছিলেন। তার অস্তিত্বের একটা নাম পেয়েছিলেন। সেটাও হারিয়ে গেলো। তার ছেলে যে বাবাকে অনুসরণ করলো। প্রথম বৌটা নাতিদের নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো – তার বাপের বাড়ি। মেয়েটার একটা গতি তো হলো। তারমতো এই অভিশপ্ত জীবনের চেয়ে মুক্তি ভালো। তিনি পারেননি -বৌটা পেরেছিলো। শাহানা বাইরে তাকিয়ে থাকেন। কতকিছু তার সামনে ঘটছে। শাহানা কিছুই দেখছেন না। তার মন আর চোখের সামনে অস্তিত্বহীনতার পর্দা। তার আশেপাশের জীবন বয়ে যায়। শাহানাকে স্পর্শ করে না, দেখেও দেখেন না কিছুই।

 

সুমি এসে ডাকলো “মা, চা করছি। খাবে?”

 

শাহানা মাথা নাড়লেন। মেয়েকে ডেকে বললেন “ওই ফুলটা চিনিস?” রাস্তার পাশের গাছের দিকে ইশারা করলেন।

 

সুমি বললো “ধুতুরার ফুল। কেন?”

 

শাহানা হাসতে লাগলেন। এই হাসিতে ঘৃণা, ক্ষোভ, জিঘাংসা আর তার অসহায়ত্ব মিশে আছে। হাসতে হাসতে বললেন “তোর বাপ আর ভাই এই ধুতুরার ফুল। ” সুমি কিছু বললো না। শাহানার হাসি থামছে না। তার মায়ের এই হাসি সুমির খুব চেনা। একটু পর শাহানা হারিয়ে যাবেন -গভীর বিষাদে।

 

৩.

 

শাহানার মা তখন বেঁচে ছিলেন। দুই সন্তান নিয়ে খুব দুর্দিন – সামনের দিন গুলো কেমন করে যাবে তিনি জানেন না। তালাক তিনি দিতে চান, কিন্তু কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায় নি। তার ভাই, বোন, কিংবা তাঁর জীবিত মা। লেখাপড়া তেমন করেননি শাহানা। কোনো সম্বল তার নেই। একবার সিলিং ফ্যান এর দিকে তাকিয়ে নিজেকে শেষ করার কথা ভেবেছিলেন। পারেননি। ওই সাহস টুকুও যে তার ছিল না। ছেলে মেয়ে দুটোর কি হবে? তার শশুর এসেছিলেন তাকে নিয়ে যেতে। তার নাতি আর নাতনির জন্য। মানুষটা মাফ চাইলেন। বললেন “বৌমা তুমি চলো। আমি যত দিন আছি -তুমি একা নও। ”

 

বুকের মধ্যে গলিত, দুর্গন্ধময় লাশটা চেপে আবারো এই চার দেয়ালে ফিরে এসেছিলেন শাহানা। দুই সন্তান নিয়ে এই সামাজিক জেলখানায় আবারো থাকতে শুরু করলেন শাহানা। কোনো অপরাধ না করেই দু’বার শাস্তি হলো তার। কেউ কোনো দিন জানতে চাইলো না – কেমন আছেন শাহানা।

 

একবার বাড়ি এসেছিলো মানুষটা। ছিলো কয়েকদিন। তাঁর নতুন বৌটা পোয়াতি! এক রাতে স্বামীর অধিকার চাইতে এলো। নিজের অব্যক্ত রাগ আর দমিয়ে রাখতে পারেননি। মাঝ রাতে চিৎকার করে গালি দিয়েছিলেন। হাতে নিয়ে ছিলেন ছুরি। ওই রাতে নিজেকে শেষ করতে, নাকি ওই পাষণ্ড কে শেষ করতে তার হাতে ছুরি উঠেছিল! জানেন না শাহানা। সেদিন মধ্যে রাতে বেরিয়ে গেলো লোকটা। তার দেবর আর জা তাকে সামলে ছিলেন। জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন- ক’ দিন বিছানায় ছিলেন ওই ঘটনার পর। অবহেলার জীবন চলতে থাকলো আজ অব্দি।

 

এখন ধর্মচর্চায় দিন পার করেন শাহানা। আর যাবার জায়গা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পন করে একটু শান্তি খোঁজেন শাহানা। একটু মুক্তি। শেষ রাতে নামাজ দাঁড়ালেন । চোখের পানি ঝরছে। কোনো বিচার দিলেন না। কে তার অপরাধী? বিছনায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকালেন শাহানা -বিশাল একটা চাঁদ। ফজরের দেরি আছে এখনো। কারো উপর এখন আর কোনো অভিমান নেই শাহানার। কারো উপর কোনো অধিকারও নেই। তার জন্য অপেক্ষা করছে – এই অভিশপ্ত জীবন। একলা বেঁচে থাকা।

 

লেখা : হায়দরী আকবর আহমেদ

কাইল, টেক্সাস

 

 

 

 

জনপ্রিয়

‘অপমানবোধ’ করছেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন, ভোটের পরে সরে যেতে চান : রয়টার্সের খবর

শাহানার গল্প – প্রফেসর. হায়দরী আকবর আহমেদ

প্রকাশের সময়: ০৪:১৯:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

শাহানা বিছানার একপ্রান্তে বসে আছেন। জানালা দিয়ে বিছানার ঠিক মাঝখানে রোদ এসে পড়েছে। শীতের সময় এইখানে তার নাতিটা শুয়ে ঘুমাতো। রোদের হালকা ওম, নাতিদের গায়ের হালকা একটা গন্ধ। শাহানা উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। গেট ঠেলে লোকটা ঢুকলো। তার ছেলের সাথে কথা বলছে। শাহানার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। সমাজের চোখে এই লোকটা তার স্বামী, তার সন্তানদের বাবা। শাহানার কেউ না- কিছুই না।

 

যেদিন জানতে পেরেছিলেন লোকটা আরেকটা বিয়ে করেছে, সেদিন থেকে তার বিবাহিত জীবনের লাশ তার সাথেই আছে। তালাক দেয়ার সাহস বা সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না। বাপের বাড়িতে ফিরে যাবেন- তার উপায়ও নেই। লাশটা তার বুকের মাঝে একাই বয়ে বেড়াতে লাগলেন। লাশটা গলেপঁচে তার সামনেই ছিল। এক সময় তার উপর পোকা পড়লো। দম বন্ধ করা জমাট দুর্গন্ধ আর গলিত কিছু স্মৃতি শুধু তার জন্য রয়ে গেলো। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে একসময় এই লাশ পঁচে গলে কঙ্কাল হলো। এখনো শাহান এই কংকাল বয়ে বেড়ান। কেউ কি তার এই কষ্ট টুকু বুঝতে পেরেছিলো? কেউ না। তিনি যেমন একা, তার কষ্ট গুলোও একা। এই বাড়ি তার ঠিকানা না। এই বাড়িতে তিনি কেন আছেন? তার অসহায় অস্তিত্ব এই বাড়িতে অশরীর ঘুরে বেড়ায়। আসবাব গুলোর ও একটা সংযোগ আছে – এই বাড়ির সাথে। তার নেই। শাহানা কেউ না।

 

বারান্দায় এক কোণে রাখা চেয়ার তার প্রিয় জায়গা। এই জায়গায় বসে শাহানা রোজ একটু আড়াল খোঁজেন। তার একান্ত আপন -নির্জনতা। রাস্তার মানুষ দেখেন। অপেক্ষা করেন -কিসের? তাও জানেন না। এক মেঘলা দুপুরে তার সন্তানদের নিয়ে এই বারান্দায় বসে ছিলেন। হাত ব্যাগে কিছুই ছিল না । তার অস্তিত্বের মতোই ফাঁকা। রিকশা করে বাপের বাড়ি যাবেন, মা তখন বেঁচে ছিলেন। রিকশা ভাড়াটাও ছিল না। এই বারান্দা থেকে রিকশা ডেকে গিয়েছিলেন – বাপের বাড়ি। তার বোন রেহানা এসেছিলো বিদেশ থেকে। রিকশার ভাড়াটা ওই মিটিয়ে দিয়েছিলো। বাড়িতে ঢুকে রেহানা আর মায়ের পাশে বসে অঝোরে কেঁদেছিলেন। তার দোষ ছিলোনা। কোনো অপরাধ করেননি শাহানা। তার সন্তানদের বাবা সবাইকে ফেলে চলে গেলো – ঘর বাধলো – নতুন সংসার। শাহানা পড়ে রইলেন তার সংসার নামের মৃতদেহ নিয়ে- একা।

 

২.

তার ছেলে প্রথম বিয়ের দুটো সন্তান। নাতিদের জন্মের পর একটা পরিচয় পেয়েছিলেন। তার অস্তিত্বের একটা নাম পেয়েছিলেন। সেটাও হারিয়ে গেলো। তার ছেলে যে বাবাকে অনুসরণ করলো। প্রথম বৌটা নাতিদের নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো – তার বাপের বাড়ি। মেয়েটার একটা গতি তো হলো। তারমতো এই অভিশপ্ত জীবনের চেয়ে মুক্তি ভালো। তিনি পারেননি -বৌটা পেরেছিলো। শাহানা বাইরে তাকিয়ে থাকেন। কতকিছু তার সামনে ঘটছে। শাহানা কিছুই দেখছেন না। তার মন আর চোখের সামনে অস্তিত্বহীনতার পর্দা। তার আশেপাশের জীবন বয়ে যায়। শাহানাকে স্পর্শ করে না, দেখেও দেখেন না কিছুই।

 

সুমি এসে ডাকলো “মা, চা করছি। খাবে?”

 

শাহানা মাথা নাড়লেন। মেয়েকে ডেকে বললেন “ওই ফুলটা চিনিস?” রাস্তার পাশের গাছের দিকে ইশারা করলেন।

 

সুমি বললো “ধুতুরার ফুল। কেন?”

 

শাহানা হাসতে লাগলেন। এই হাসিতে ঘৃণা, ক্ষোভ, জিঘাংসা আর তার অসহায়ত্ব মিশে আছে। হাসতে হাসতে বললেন “তোর বাপ আর ভাই এই ধুতুরার ফুল। ” সুমি কিছু বললো না। শাহানার হাসি থামছে না। তার মায়ের এই হাসি সুমির খুব চেনা। একটু পর শাহানা হারিয়ে যাবেন -গভীর বিষাদে।

 

৩.

 

শাহানার মা তখন বেঁচে ছিলেন। দুই সন্তান নিয়ে খুব দুর্দিন – সামনের দিন গুলো কেমন করে যাবে তিনি জানেন না। তালাক তিনি দিতে চান, কিন্তু কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায় নি। তার ভাই, বোন, কিংবা তাঁর জীবিত মা। লেখাপড়া তেমন করেননি শাহানা। কোনো সম্বল তার নেই। একবার সিলিং ফ্যান এর দিকে তাকিয়ে নিজেকে শেষ করার কথা ভেবেছিলেন। পারেননি। ওই সাহস টুকুও যে তার ছিল না। ছেলে মেয়ে দুটোর কি হবে? তার শশুর এসেছিলেন তাকে নিয়ে যেতে। তার নাতি আর নাতনির জন্য। মানুষটা মাফ চাইলেন। বললেন “বৌমা তুমি চলো। আমি যত দিন আছি -তুমি একা নও। ”

 

বুকের মধ্যে গলিত, দুর্গন্ধময় লাশটা চেপে আবারো এই চার দেয়ালে ফিরে এসেছিলেন শাহানা। দুই সন্তান নিয়ে এই সামাজিক জেলখানায় আবারো থাকতে শুরু করলেন শাহানা। কোনো অপরাধ না করেই দু’বার শাস্তি হলো তার। কেউ কোনো দিন জানতে চাইলো না – কেমন আছেন শাহানা।

 

একবার বাড়ি এসেছিলো মানুষটা। ছিলো কয়েকদিন। তাঁর নতুন বৌটা পোয়াতি! এক রাতে স্বামীর অধিকার চাইতে এলো। নিজের অব্যক্ত রাগ আর দমিয়ে রাখতে পারেননি। মাঝ রাতে চিৎকার করে গালি দিয়েছিলেন। হাতে নিয়ে ছিলেন ছুরি। ওই রাতে নিজেকে শেষ করতে, নাকি ওই পাষণ্ড কে শেষ করতে তার হাতে ছুরি উঠেছিল! জানেন না শাহানা। সেদিন মধ্যে রাতে বেরিয়ে গেলো লোকটা। তার দেবর আর জা তাকে সামলে ছিলেন। জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন- ক’ দিন বিছানায় ছিলেন ওই ঘটনার পর। অবহেলার জীবন চলতে থাকলো আজ অব্দি।

 

এখন ধর্মচর্চায় দিন পার করেন শাহানা। আর যাবার জায়গা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পন করে একটু শান্তি খোঁজেন শাহানা। একটু মুক্তি। শেষ রাতে নামাজ দাঁড়ালেন । চোখের পানি ঝরছে। কোনো বিচার দিলেন না। কে তার অপরাধী? বিছনায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকালেন শাহানা -বিশাল একটা চাঁদ। ফজরের দেরি আছে এখনো। কারো উপর এখন আর কোনো অভিমান নেই শাহানার। কারো উপর কোনো অধিকারও নেই। তার জন্য অপেক্ষা করছে – এই অভিশপ্ত জীবন। একলা বেঁচে থাকা।

 

লেখা : হায়দরী আকবর আহমেদ

কাইল, টেক্সাস