
শেষবার (৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪) আমার সাথে আলিফের যখন দেখা হয় তখন রাত নয়টা বাজে। সাড়ে আটটার কথা বলে আলিফ পার্কে আসে নয়টায়। আধঘন্টা দেরি। নয়টায় আমার জহুরুল কাইয়ুম স্যারের সাথে বই নিয়ে আলোচনার কথা ছিলো। আলিফ আসা মাত্রই পার্কে থেকে বেরিয়ে গেলাম অক্ষয় দাদার দোকানে। সেখানে মিনিট পাঁচেক থেকে গেলাম কাইয়ুম স্যারের সাথে দেখা করতে।
রেলগেট ছাত্র ইউনিয়নের অফিসের সামনের চায়ের দোকানে আমি আর স্যার বসলাম আলোচনায়। আলিফ আর শিমুল বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সময় বেশি লাগছিলো জন্য আলিফ বার বার কল দিচ্ছিলো। কল কেটে দিতে দিতে একপর্যায়ে ফোনটা বন্ধ করে রাখলাম। মিনিট পাঁচেক পর আলিফ ডাক দিলো, কিরে জিম তোর হয়না?
স্যারের কাছে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে বের হলাম। আলিফের যে ভয়েজ টন ছিলো তাতে করে পরের ভয়েজে বাক্য বিপদজ্জনক হতে পারতো। বের হতেই আলিফ বলল – চা খাবো চল। আমি বললাম – চল তোকে আজ কফি খাওয়াবো। আলিফ আর শিমুল হাসাহাসি করলো।
চা খাইতে গেলাম কাঞ্চন ভাইয়ের দোকান হকার্স মার্কেটে। মাঝের রাস্তাটুকুতে আলিফের সেকি আফসোস আমার বিয়ের অনুষ্ঠান না হবার জন্য। যখন শিমুলের কাছে জানলো আমার দ্বিতীয় সন্তান আসছে তখন আফসোস হয়ে গেলো কয়েক গুণ। কত ধরণের প্ল্যান পরিকল্পনা করলো আমার অনাগত সন্তানের আকিকার অনুষ্ঠান নিয়ে। আইটেম কি কি হবে, কে কে থাকবে, কোথায় অনুষ্ঠান হবে সব সিদ্ধান্ত নিলো আলিফ আর শিমুল। আমি শুনলাম আর হাসলাম।
ভাইয়ের দোকানে গিয়ে ভাইকে বললাম – ভাই আজকে কফি খাওয়াবো আমি। চারটা কফি অর্ডার করেন। আলিফ বললো – না, আমি কফি খাবো না। আমি লাল চা খাবো। লাল চা, আদা দিয়ে হিট বেশি। এটা আলিফের ডায়লগ। চায়ের দোকানে গিয়ে এই ডায়লগ দিবেই।
আমরা তিনজন কফি খেলাম, শুধু আলিফ চা খেলো। বাসস্ট্যান্ড এসে বাড়ি যাবার সময় আলিফ বললো- কোন কথাই হলো না তোর সাথে। কত কথা বলার ছিলো। কিছুই হলো না। আমি কালকে চলে যাচ্ছি। তোরা শালা বেইমান। কোন খোঁজখবর না দিয়েই চলে আসিস। গতবার আসলি আমার বাপের সাথে দেখা করলি আর আমার সাথে দেখা করলি না।
আমি আর শিমুল বললাম – তুই আগামীকাল থাক। পরশু যাস। আমরা তোর জন্য আগামীকাল সন্ধ্যায় কোন কাজ রাখবো না। পুরো সময় তোর সাথে আড্ডা দিবো।
আলিফ বললো – ঠিক আছে আমি ভেবে দেখি। কি হয়? জানাবো রাতে বেলা।
আমি আর শিমুল জোর দিয়েই বললাম – তুই যাস না বন্ধু। বোঝার চেষ্টা কর। আমরা আড্ডা দিবো সত্য। তোর সাথেও আমাদের অনেক কথা আছে।
আলিফ চলে গেলো। রাতে আলিফ ম্যাসেজ দিলো (আলিফের পাঠানো ম্যাসেজগুলো অপরিবর্তিতভাবে দেয়া হলো) – ‘খারাপ লাগে বিষয়গুলা…এতদিন থাকলাম, আসলি না। আমার যাওয়া জরুরী, তুই আসলি…কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়। মানুষের সামনে হাসাহাসি করতেই সময় যায়। অনেক কথা থাকে ঐভাবে তো বলা যায় না…অনেকদিন থাকলাম, একবারে চলে যাচ্ছি। MBA+Job Preparation নিবো। কিছু Important আলাপ ছিলো। Business Plan নিয়া কথা বলা লাগতো। তুই শালা আসিস, যাস হুটহাট। সময় ও দেস না। কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তো দরকার…দুআ করিস আমার জন্য ভালো কিছু করতে হবে হালাল পেশা হোক সরকারী/বেসরকারি।’
আমি আবার থাকার জন্য অনুরোধ করলাম। বলল – কালকে আর থাকতে পারবে না। অ্যাংকেল আন্টিও চাচ্ছে, চলে যাক আগামীকাল। এছাড়া আগামীকাল আন্টি যাবে ওর সাথে পলাশবাড়ী পর্যন্ত। ওর এক মামা নাকি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে তাকে দেখতে যাবে। পরেরবার দেখা হবে।
আমি বললাম – আবার কবে দেখা হয়, না হয়। তুই বাড়িতে বল জীম জোরাজুরি করতেছে।
আলিফ বললো- না রে, থাকা হবে না। ইচ্ছে করতেছে কিন্তু উপায় নাই।
– দেখ বন্ধু, কিছু বলে যদি থাকা যায়!
– দুআ কর,ভালো কিছু করা লাগবে। বাপ মা এর কাছে এ বয়সে নিতে ভালো লাগে না। কবে কিছু করবো এটাই চিন্তা করি খালি। তবুও ঠিক আছে। দেখি। সন্ধ্যায় না হলেও সকালে আড্ডা দিবো। তোর বাড়ির আশেপাশে বা দোকানে আড্ডা দিলাম।
আমি সম্মতি দিলাম। পরেরদিন সকালে কল দিলাম ধরলো না। এগারোটায় কল দিয়ে জানালো ভোর রাতে ঘুমাইছে। তাই উঠতে দেরি হলো। এইবার আর দেখা হবে না। একটু পর বেরিয়ে যাবে। আমিও আর জোরাজুরি করলাম না। একটায় আবার কল দিলাম। বললাম – কৈ রে তুই আসবি না?
চাপা গলায় বললো – আমি না বললাম চলে যাচ্ছি। আমি এখন বাসে। পলাশবাড়ী পার হচ্ছি। পৌঁছায় তোকে কল দিবো। পৌঁছানো পর কল দিয়েছিলো। কথাও হয়েছিলো। আভিমান ছিলো আমার ওপর। সময় না দেবার অভিমান, দেখা না করার অভিমান।
আমি যখন গাইবান্ধা থাকতাম তখন সবসময় আলিফ আমায় পার্কে ডাকতো। আমি পলাশপাড়া থেকে পার্কে যেতাম। আলিফ ডাকলে যেতেই হতো। ব্যস্ততা থাকলেও বলতো – পাঁচ মিনিটের জন্য আয়। দেখা করেই চলে যাস।
সবসময় যেতাম পলাশপাড়া থেকে কিন্তু আজ (১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪) যাচ্ছি ঢাকা থেকে। এখন অনেক ব্যস্ততার মাঝে সময় পার করছিলাম। এছাড়া গত ছয় তারিখেই ফিরলাম। যারা কোন ইচ্ছা ছিলো না। তবুও যেতেই হবে। এইবার আলিফ কোন ফোন দেয়নি, কিন্তু তবুও ডাকছে। আলিফ ডাকছে গাইবান্ধায়। এই ডাকাই শেষ ডাকা। আমায় তো যেতে হবেই। আলিফকে দেখে আমার বলতেই হবে – বন্ধু… বন্ধু… আমায় মাফ করে দিস।
লেখা : ওয়াজেদ হোসেন জীম
ওয়াজেদ হোসেন জীম 





















