
বিমল সরকার : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা আজ এক সংবেদনশীল প্রান্তে দাঁড়িয়ে। নির্বাচন সামনে, উত্তেজনা বাড়ছে, প্রত্যাশা এবং আশঙ্কা—দুটোই পাশাপাশি হাঁটছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি যে সত্যটি আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো—বাংলাদেশের মূল শক্তি তার বহুত্ববাদ, আর সেই বহুত্ব রক্ষা করাই ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্রের প্রথম শর্ত। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ সহাবস্থান করছে বহুকাল ধরে। এই বৈচিত্র্য আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মানবিকতা এবং সভ্যতার ভিত্তি। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এই বৈচিত্র্যই বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। নির্বাচনের আগে কিংবা পরে সহিংসতা, প্রতিশোধ, ঘৃণা—এগুলো কেবল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নয়, পুরো জাতিকেই দুর্বল করে। কারণ একটি জাতির শক্তি সংখ্যায় নয়—তার ন্যায়বোধে, সহমর্মিতায় এবং মানুষের মর্যাদা রক্ষার সক্ষমতায়। আমরা মনে রাখি—নির্বাচন সাময়িক, কিন্তু রাষ্ট্র চিরস্থায়ী। ক্ষমতার পরিবর্তন রাজনৈতিক দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা একটি সভ্য জাতির কাছে আরও বড় দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব— কোনো নাগরিক যেন তার ধর্ম, জাতি, মত বা পরিচয়ের কারণে হুমকির মুখে না পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন রাজনৈতিক রং দেখে মানুষকে বিচার না করে। বিচারব্যবস্থা যেন বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করে। রাজনীতিকেরা যেন প্রতিপক্ষকে শত্রু নয়—সহনাগরিক হিসেবে দেখে। কিন্তু একই সঙ্গে জনগণেরও দায়িত্ব আছে— প্রতিবেশীর নিরাপত্তা মানে নিজের নিরাপত্তা। সংখ্যালঘুর বাড়ি রক্ষা করা মানে দেশের সম্মান রক্ষা করা। উসকানিতে না জড়ানো মানে শান্তিকে শক্তিশালী করা। এটাই নাগরিকচেতনার প্রকৃত রূপ। আমরা কালের চিঠির পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই— বাংলাদেশের বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা শুধু নৈতিক দায় নয়; বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষার পথও এটিই। কোনো নির্বাচন, কোনো মতাদর্শ, কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানুষের জীবনের চেয়ে বড় নয়। মানুষই রাষ্ট্রের মূল, আর রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা কামনা করি— আসন্ন নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ, নির্বাচনের পর যেন কোনো নাগরিক আতঙ্কে না থাকে, কোনো মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা বা বাড়িঘরে আগুন না লাগে, কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধ যেন জাতিকে আর বিভক্ত না করে। বাংলাদেশকে এগোতে হলে প্রয়োজন তিনটি জিনিস— ন্যায়, ঐক্য এবং মানবিকতা। এই তিনটিই বহুত্ববাদের ভিত্তি, আর এই তিনটিই একটি সভ্য রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। শেষে একটাই কথা— বহুত্ববাদ রক্ষা মানে শুধুই সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা নয়; এর মানে বাংলাদেশের আত্মাকে রক্ষা করা।
নিজস্ব প্রতিবেদক 




















