
তাসলিমুল হাসান সিয়াম:
গাইবান্ধা জেলাজুড়ে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে চারজন মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় গরু চুরির অভিযোগে, অপর আর একজন নিহত হয়েছেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় — যিনি ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। পরপর দুটি এমন ঘটনা পুরো জেলাজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে এবং প্রশ্ন তুলেছে— “বিচারের আগে বিচারকার্য সম্পন্ন করছে কারা?”
গত শনিবার (১ নভেম্বর) গভীর রাতে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে গরু চুরির অভিযোগে তিনজনকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা।
স্থানীয়রা জানান রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে এক ব্যক্তির গোয়ালঘর থেকে তিনটি গরু চুরি করে পালানোর চেষ্টা করে তিনজন। বিষয়টি টের পেয়ে এলাকাবাসী ধাওয়া করলে তারা প্রাণ বাঁচাতে রাস্তার পাশের একটি পুকুরে লাফ দেয়। পরে স্থানীয়রা তাদের ধরে বেধড়ক মারধর করে। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজন মারা যান এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে আরও একজনের মৃত্যু হয়।
পুলিশের ধারণা, নিহতরা বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার একটি সংঘবদ্ধ গরুচোর চক্রের সদস্য। তবে তাদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ বুলবুল আহমেদ বলেন, “ঘটনাটি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। যেভাবেই হোক আইন হাতে তুলে নেওয়া ঠিক নয়। ইতিমধ্যে ৩৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে”
অপরদিকে এই হত্যাকাণ্ডের ঠিক একদিন আগে শনিবার সকালে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা নবাবগঞ্জ গ্রামে গরু চোর সন্দেহে মো. আব্দুস সালাম নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
নিহত আব্দুস সালাম (৪৫) বেলকা ইউনিয়নের রামডাকুয়া গ্রামের ওমেদ আলীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, সালাম দীর্ঘদিন ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। তিনি কারও বাড়িতে কাজ করে বা মানুষের কাছে সাহায্য চেয়ে জীবন চালাতেন। তার বিরুদ্ধে কখনও চুরির অভিযোগ ওঠেনি।
ঘটনার দিন রাত আড়াইটার দিকে এক স্থানীয় নারীর গোয়ালঘরে ঢোকার পর চোর সন্দেহে সালামকে ধরে ফেলে এলাকাবাসী। এরপর তাকে রশি দিয়ে বেঁধে বেধড়ক মারধর করা হয়। ভোরে যখন তিনি অচেতন হয়ে পড়েন, তখনো নির্যাতন থামেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দুলালী বেগম নামে এক নারীকে আটক করেছে পুলিশ।
সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল হাকিম আজাদ বলেন, “ঘটনার তদন্ত চলছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। যারা জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
আব্দুস সালামের পরিবারের সদস্যরা জানান, “সে মানসিক রোগী ছিল, কখনও চুরি করেনি। মানুষ তাকে খেতে দিত, সে কৃতজ্ঞ হয়ে কাজ করত। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে নিছক সন্দেহে।” নিহতের তিনটি শিশু সন্তান এখন বাবাহারা হয়ে নিঃস্ব।
এদিকে দুই দিনে দুই উপজেলায় চারজনের প্রাণহানি — এটি শুধু স্থানীয় আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়, বরং গণমানসিকতারও প্রতিফলন। আইনের শাসন ও নাগরিক সচেতনতার অভাবে গ্রামবাংলায় “চোর আটক ” মানেই তাৎক্ষণিক বিচার শুরু হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে।
গাইবান্ধার মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “এই ধরনের ঘটনায় অপরাধী যেমন বিচারের মুখোমুখি হয় না, তেমনি নিরপরাধ লোকও মারা যায় সন্দেহের বশে। সমাজে ভয় ও অন্যায়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে।”
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সি-সার্কেল) রশিদুল বারী মুঠোফোনে জানান , “সাম্প্রতিক এই দুটি ঘটনায় পৃথক মামলা করা হয়েছে । চুরি, ডাকাতি বা অপরাধ দমনের কাজ পুলিশের। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটলে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।”
নিজস্ব প্রতিবেদক 



















