
বাংলাদেশ একটি বহুধর্মী ও বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশ। এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রতিবছর আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার আগমন উপলক্ষে এ পূজা উদযাপিত হয়। পুরাণে বর্ণিত আছে, মহিষাসুর নামক অসুরকে পরাজিত করে দেবী দুর্গার বিজয়ই এই পূজার মূল তাৎপর্য। তাই দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি শুভ শক্তির বিজয়, অশুভ শক্তির বিনাশ এবং ন্যায়, সৎসাহস ও মানবকল্যাণের প্রতীক– এটা তাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক মিলনের উৎসব হিসেবেও পরিচিত। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজনরা এ সময় পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি ফেরেন। ভিন্নধর্মের প্রতিবেশীরাও এ নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। অনেকে তাতে যোগ দেয়। রাষ্ট্রও এ উৎসবকে সমর্থন করে। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর কোষাগার থেকে উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ করে পূজার সফল ও সুশৃঙ্খল সম্পন্নতার জন্য।
দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, এটি স্থানীয় শিল্পী, কারিগর, ফুল ব্যবসায়ী, প্রতিমা নির্মাতা, দর্জি ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য আয়-রোজগারের উৎস। পূজামণ্ডপ, আলোকসজ্জা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনে এবং অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক সময় শহরের ব্যস্ত সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ বাজারে একাধিক মণ্ডপ তৈরি হলে যানজট সৃষ্টি হয়। মণ্ডপে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয় বলে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থী, শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের জন্য তা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আতশবাজির ব্যাপক ব্যবহার শুধু শব্দদূষণই বাড়ায় না, শিশু ও পশু-পাখিকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। বিসর্জন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক, পলিস্টাইরিন ও অ-বিয়োজ্য উপকরণ জলাশয় ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আজকের সমাজে অশুভ শক্তি শুধু পুরাণের চরিত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; অন্যের কষ্ট, জনজীবনের অসুবিধা, শব্দ ও পরিবেশ দূষণ এবং অযথা ব্যাঘাতও এক ধরনের অশুভ কাজ। সুতরাং পূজার আসল বার্তায় শুভ শক্তির উদযাপন ও অশুভ শক্তি দমন যেমন মূল কথা, তেমনি সমাজে সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখাও অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য হিন্দু সমাজের ভেতরেই এসব নিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠছে। মণ্ডপগুলো সাধারণত প্রশাসনের পরামর্শ মেনেই স্থাপিত হয়। আতশবাজির ব্যবহার নিয়ে সতর্কতাও লক্ষণীয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা বাংলাদেশের চেয়েও ব্যাপক আকারে উদযাপিত হয়। সেখানকার দুর্গাপূজা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেখানেও উৎসব ঘিরে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্নকারী তৎপরতা সম্পর্কে জনপরিসরে আলোচনা হচ্ছে।
এসব কথা বলার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই উৎসবের আনন্দ ম্লান করা নয়, বরং দুর্গাপূজার আসল লক্ষ্য যে মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা, সেটি তুলে ধরা। এটি শেখায়, উৎসবের আনন্দ শুধু নিজস্ব অভিজ্ঞতা নয়, বরং অন্যের সুখ ও শান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। পূজা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা নাগরিক জীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং সমাজে কল্যাণকর বার্তা প্রেরণ করে।
অতএব, ধর্মীয় উৎসবকে আনন্দঘন, সুশৃঙ্খল ও ভ্রাতৃত্ববোধসম্পন্ন পরিবেশে রূপ দেওয়া উচিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গার পূজা করে; যাতে অশুভ শক্তি দূর হয়, সমাজে ন্যায়, শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব স্থায়ী হয়।
পূজা এমনভাবে আয়োজন করা উচিত, যাতে অন্যদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও প্রকৃতি ব্যাহত না হয়। কারণ শেষ পর্যন্ত দেবী দুর্গার প্রকৃত বার্তা হলো– দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন। ধর্মীয় উৎসবের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তখনই, যখন তা মানবিকতা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, পরিবেশ সচেতনতা ও অন্যের কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত হয়।
তবে একইসঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় যেন পূজার উদযাপনের স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট না হয়। এ বিষয়ে সরকারকে যেমন সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে, তেমনি সমাজের সচেতন নাগরিকদেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, এ কথা আমরা সবাই সুযোগ পেলেই দাবি করি। এ দাবি যেন ফাঁপা বুলিতে পর্যবসিত না হয়।
নিজস্ব প্রতিবেদক 




















