
বিমল সরকার: তিস্তার বুক দিয়ে বহু বছর ধরে ভেসে এসেছে মানুষের হাহাকার।কৃষকের ধান, রোগীর জীবন, শিক্ষার্থীর সময় -সবকিছুই যেন আটকে থাকতো নদীর অনিশ্চয়তায়। বন্যার ঢেউ, ঝড়ের রাতে মাঝনদীতে আটকে পড়া নৌকা, কিংবা ভোরবেলা ঘাটে দাঁড়িয়ে অন্তহীন অপেক্ষা -এসবই ছিল গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম কিংবা উত্তরবঙ্গের মানুষের প্রতিদিনের নিয়তি। কিন্তু নিয়তি কখনোই শেষ কথা নয়- এ কথাই আজ আবার প্রমাণিত হলো। মওলানা ভাসানী সেতুর উদ্বোধন শুধু একটি অবকাঠামোগত অর্জন নয়, বরং এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, আন্দোলনের সফলতা, আর মানুষের হৃদয় থেকে উঠে আসা এক কালোত্তীর্ণ কবিতা। এই সেতুর প্রতিটি ইস্পাতের গার্ডার যেন সংগ্রামের প্রতীক আর প্রতিটি স্প্যান যেন দীর্ঘশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া স্বপ্নের ফসল । নদীর বুক থেকে নতুন ভোর ব্রীজের অভাবে একদিন মরে গেছে তুলসীঘাটের নদী ! ইতিহাসের কষ্ট বুকে নিয়ে তাই তুলসীঘাট জানে একটি সেতু শুধু জলের উপর দাঁড়ানো কিছু কংক্রিটের উপাদান নয় – যা অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের প্রতীক । আমাদের সময়ের তুলসীঘাট, সাদুল্যাপুর কিংবা গাইবান্ধা শহরের মানুষগুলো বছরের পর বছর ধরে এই স্বপ্নের কথা বলেছে, চিন্তা করেছে কিন্তু অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের কথা শুধু বালাসীঘাট পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং অবহেলিত চেতনার গভীর খাদে ডুবে গেছে ! আজ তারা তাই গর্ব করে বলছে -“ আমরা এবার নদীকে জয় করেছি “ আগামীতে হয়তো ব্রহ্মপুত্রের বালাসীঘাটটাও হবে নদীবন্দর। ২০২৫ এর ভাসানী সেঁতুর কারণে এখন ধান যাবে গাড়িতে, ছাত্র পৌঁছাবে ক্লাসে, রোগী পৌঁছাবে হাসপাতালে, আর কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার খুলে যাবে।যা শুধু গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামকে যুক্ত করেনি-এটি যুক্ত করেছে মানুষের আশা, শ্রম ও ভবিষ্যৎকেও ! আমরা ভুলে যেতে পারি না- এই সেতু হঠাৎ করে আসেনি।এটি এসেছে বছরের পর বছর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।গ্রামের হাটে, শহরের পথে, ঘাটের ভিড়ে মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়েছে এই দাবী। আমাদের কলমে, আমাদের সংবাদে, আমাদের প্রতিবাদে সেই দাবী প্রতিধ্বনিত হয়েছে।আজকের এই জয়গান তাই জনগণেরই জয়গান, যাদের কণ্ঠস্বর থেমে থাকেনি ! ৯২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সেতু উত্তরাঞ্চলের শিল্প, কৃষি ও শিক্ষার সম্ভাবনা বাড়াবে বহুগুণ। এটি কেবল রাস্তা নয়, বরং উন্নয়নের মহাসড়ক- যা যুক্ত করবে গ্রাম থেকে শহর, ক্ষেত থেকে বাজার, প্রান্তিক থেকে কেন্দ্র।সেতুটি তাই জাতীয় অর্থনীতির সাথেও যুক্ত হবে, যেমনটি যুক্ত হবে মানুষের হৃদয়ের সাথে। আজকের দিনে আমরা বলতে পারি- মওলানা ভাসানী সেতু কেবল ইস্পাত-সিমেন্টের কাঠামো নয়, এটি মানুষের আত্মত্যাগের স্মৃতিস্তম্ভ।এটি আমাদের কালের প্রতীক-যা প্রমাণ করে, নদীর স্রোত মানুষকে থামাতে পারে না, প্রতীক্ষা কখনো বৃথা যায় না, এবং ঐকান্তিক সংগ্রাম একদিন ইতিহাসকে পাল্টে দেয়। তিস্তার ঢেউ আজও বইছে, কিন্তু তার ভাষা বদলে গেছে। আগে সে বলতো—“তুমি আটকে আছো।” আজ সে বলছে- “তুমি জয়ী হয়েছো।”
নিজস্ব প্রতিবেদক 




















