মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সম্পাদকীয় – ভেজাল ওষুধের বিষফাঁদ , রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতার কাছে একটা জবাবদিহি

 বিমল সরকার:  এ কোন অন্ধকার? এ কোন মৃত্যু-সঙ্গীত প্রতিদিন আমাদের রক্তে মিশছে? দেশের মানুষের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে বিষ- ভেজাল ও নকল ওষুধের আকারে। এটি আর নিছক অপরাধ নয়, এটি পরিকল্পিত গণহত্যা। মিটফোর্ড মার্কেট থেকে শুরু করে রাজধানী, সেখান থেকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে মৃত্যুর বিষফোঁটা। সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও স্বার্থান্ধ ব্যবসায়ী মিলে রচনা করছে মৃত্যুর বাণিজ্য। এক সময় আমরা দেখেছিলাম আশির দশকে প্যারাসিটামল ট্র্যাজেডি- দুই সহস্রাধিক শিশু অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে। আমরা ভেবেছিলাম, সেই শোক রাষ্ট্রকে জাগাবে, আইন কঠোর হবে, শাস্তি নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবের করুণ রূপরেখা- আজও গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে, হাসপাতালের দরজায়, এমনকি ফার্মেসির তাকেও-মৃত্যুর প্যাকেট সাজানো থাকে সাদা কাগজে মোড়ানো “ওষুধ” নামে। ৯০ ভাগ ফার্মেসিতে নেই প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট। ওষুধের বেচাকেনা যেন বাজারের আলুর মতো, যার কোনও চিকিৎসা-শৃঙ্খলা নেই, কোনও মানবিকতা নেই। অথচ এগুলো প্রাণরক্ষার দ্রব্য, আর এখন তা হয়ে উঠছে প্রাণনাশের হাতিয়ার। কিডনি বিকল, ক্যানসার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থায়ী ক্ষতি- সবকিছুই ঘটছে এই বিষবাণের আঘাতে। প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. হারুন অর রশীদ সঠিকভাবেই বলেছেন- এটি কেবল স্বাস্থ্যগত সংকট নয়, এটি জাতির ভবিষ্যতের ওপর এক গভীর আঘাত। কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, এর অন্যতম কারণ এই ভেজাল ওষুধ। অথচ আমাদের প্রশাসন “মনিটরিং” শব্দটিকেই পরিণত করেছে কাগজের বুলি- বাস্তবে তাতে জীবন রক্ষার কোনও হাতিয়ার নেই। আমরা প্রশ্ন করি- রাষ্ট্র কোথায়? আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোথায়? কেন দৃশ্যমান শাস্তি নেই? কেন মৃত্যুবাণিজ্যের মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে? কেন কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কতিপয় নেতা পর্যন্ত এই হত্যার ব্যবসায় অংশীদার? এটি কেবল নৈতিক অবক্ষয় নয়, এটি রাষ্ট্রের নীরব স্বীকৃতির শামিল। আমরা দাবি জানাই- ১. ভেজাল ওষুধ বিক্রি ও উৎপাদনকে হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. প্রতিটি ফার্মেসিতে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। ৩. সারা দেশে ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করতে স্বাধীন ও শক্তিশালী মনিটরিং বোর্ড গঠন করতে হবে। ৪. অসাধু সিন্ডিকেটের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। এই লড়াই কেবল স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নয়, এটি আমাদের মানবতার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আমরা যদি আজও চুপ থাকি, তবে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। ভেজাল ওষুধের বিষ শুধু মানুষের শরীরে নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক মেরুদণ্ডেও ঢুকে পড়েছে। এই বিষমুক্তি হবে না কেবল প্রশাসনিক ফাইলে কলম চালিয়ে; এর জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিকের প্রতিবাদ, এবং অপরাধীদের প্রতি নির্মম ন্যায়বিচার। এখনই সময়- বিষের এই ফাঁদ ছিঁড়ে ফেলার, এখনই সময়- প্রতিটি মানুষের জীবনকে মৃত্যুবাণিজ্যের হাত থেকে উদ্ধার করার, এখনই সময়- রাষ্ট্রকে তার মূল দায়িত্বের সামনে দাঁড় করানোর। না হলে ইতিহাস লিখে রাখবে- ২০২৫ সালে আমরা ছিলাম সেই জাতি, যারা নীরবে মৃত্যুকে পান করেছিল ওষুধের বোতলে ভরে।

জনপ্রিয়

ইউথ ক্লাইমেট স্মল গ্র্যান্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল সৃজনশীল গাইবান্ধা  

সম্পাদকীয় – ভেজাল ওষুধের বিষফাঁদ , রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতার কাছে একটা জবাবদিহি

প্রকাশের সময়: ০৪:১০:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫

 বিমল সরকার:  এ কোন অন্ধকার? এ কোন মৃত্যু-সঙ্গীত প্রতিদিন আমাদের রক্তে মিশছে? দেশের মানুষের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে বিষ- ভেজাল ও নকল ওষুধের আকারে। এটি আর নিছক অপরাধ নয়, এটি পরিকল্পিত গণহত্যা। মিটফোর্ড মার্কেট থেকে শুরু করে রাজধানী, সেখান থেকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে মৃত্যুর বিষফোঁটা। সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও স্বার্থান্ধ ব্যবসায়ী মিলে রচনা করছে মৃত্যুর বাণিজ্য। এক সময় আমরা দেখেছিলাম আশির দশকে প্যারাসিটামল ট্র্যাজেডি- দুই সহস্রাধিক শিশু অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে। আমরা ভেবেছিলাম, সেই শোক রাষ্ট্রকে জাগাবে, আইন কঠোর হবে, শাস্তি নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবের করুণ রূপরেখা- আজও গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে, হাসপাতালের দরজায়, এমনকি ফার্মেসির তাকেও-মৃত্যুর প্যাকেট সাজানো থাকে সাদা কাগজে মোড়ানো “ওষুধ” নামে। ৯০ ভাগ ফার্মেসিতে নেই প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট। ওষুধের বেচাকেনা যেন বাজারের আলুর মতো, যার কোনও চিকিৎসা-শৃঙ্খলা নেই, কোনও মানবিকতা নেই। অথচ এগুলো প্রাণরক্ষার দ্রব্য, আর এখন তা হয়ে উঠছে প্রাণনাশের হাতিয়ার। কিডনি বিকল, ক্যানসার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থায়ী ক্ষতি- সবকিছুই ঘটছে এই বিষবাণের আঘাতে। প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. হারুন অর রশীদ সঠিকভাবেই বলেছেন- এটি কেবল স্বাস্থ্যগত সংকট নয়, এটি জাতির ভবিষ্যতের ওপর এক গভীর আঘাত। কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, এর অন্যতম কারণ এই ভেজাল ওষুধ। অথচ আমাদের প্রশাসন “মনিটরিং” শব্দটিকেই পরিণত করেছে কাগজের বুলি- বাস্তবে তাতে জীবন রক্ষার কোনও হাতিয়ার নেই। আমরা প্রশ্ন করি- রাষ্ট্র কোথায়? আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোথায়? কেন দৃশ্যমান শাস্তি নেই? কেন মৃত্যুবাণিজ্যের মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে? কেন কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কতিপয় নেতা পর্যন্ত এই হত্যার ব্যবসায় অংশীদার? এটি কেবল নৈতিক অবক্ষয় নয়, এটি রাষ্ট্রের নীরব স্বীকৃতির শামিল। আমরা দাবি জানাই- ১. ভেজাল ওষুধ বিক্রি ও উৎপাদনকে হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. প্রতিটি ফার্মেসিতে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। ৩. সারা দেশে ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করতে স্বাধীন ও শক্তিশালী মনিটরিং বোর্ড গঠন করতে হবে। ৪. অসাধু সিন্ডিকেটের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। এই লড়াই কেবল স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নয়, এটি আমাদের মানবতার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আমরা যদি আজও চুপ থাকি, তবে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। ভেজাল ওষুধের বিষ শুধু মানুষের শরীরে নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক মেরুদণ্ডেও ঢুকে পড়েছে। এই বিষমুক্তি হবে না কেবল প্রশাসনিক ফাইলে কলম চালিয়ে; এর জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিকের প্রতিবাদ, এবং অপরাধীদের প্রতি নির্মম ন্যায়বিচার। এখনই সময়- বিষের এই ফাঁদ ছিঁড়ে ফেলার, এখনই সময়- প্রতিটি মানুষের জীবনকে মৃত্যুবাণিজ্যের হাত থেকে উদ্ধার করার, এখনই সময়- রাষ্ট্রকে তার মূল দায়িত্বের সামনে দাঁড় করানোর। না হলে ইতিহাস লিখে রাখবে- ২০২৫ সালে আমরা ছিলাম সেই জাতি, যারা নীরবে মৃত্যুকে পান করেছিল ওষুধের বোতলে ভরে।