
বিমল সরকার : বাংলা আকাশে আজ যেন এক অদৃশ্য গীতের ধ্বনি ভাসছে- যে গীতিতে বেদনা অথচ গভীর প্রশান্তিতে ভরপুর ! এটি সেই দিন, যেদিন আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দুর্লভ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পার্থিব জীবনযাত্রার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালেও রেখে গেলেন এমন এক সৃষ্টির দীপশিখা, যা সময়ের সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে আজও জ্বলছে সভ্যতার হৃদয়ে ! ১৯৪১ সালের এই দিনে, কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসপ্রাচুর্য ঘরে তাঁর শ্বাস থেমে গেলেও থামেনি তাঁর কবিতা, গান কিংবা তাঁর মানবতার আহ্বান। বরং, মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টির বিস্তার যেন আরও গভীর, আরও বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। সময়ের প্রতিটি প্রজন্মে নতুন করে জন্ম নিয়েছে রবীন্দ্রনাথ-নতুন ভাষায়, নতুন সুরে, নতুন আলোয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না শুধু একজন কবি বা সাহিত্যিক; তিনি ছিলেন এক জীবন্ত মহাকাব্য। তাঁর রচনার ভেতরে আছে পদ্মা নদীর গর্জন, আছে শান্তিনিকেতনের বিকেলের রোদ, আছে বাউল হৃদয়ের উন্মুক্ত গান, আছে শীতের কুয়াশায় ভোরের নিস্তব্ধতা, আবার আছে মানুষের মুক্তির জন্য তীব্র প্রতিবাদী স্বর। তিনি শেখালেন-প্রকৃত কবি সেই, যিনি নিজের সত্তাকে জাতির সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারেন; প্রকৃত প্রেমিক সেই, যিনি নিজের ভালোবাসাকে মানবতার পূর্ণতায় রূপ দেন। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি-র ইংরেজি অনুবাদের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন কেবল ব্যক্তিগত সম্মান ছিল না-এটি বাংলা ভাষার আকাশে এক অনন্ত নক্ষত্রের উদয়। তাঁর গান আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি কোনো একক মানুষের অনুভূতি নয়-এটি কোটি মানুষের হৃদয়ের রক্তস্রোত, যা স্বাধীনতার ইতিহাসে অমোচনীয়। রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতেও সৃষ্টির আগুন নিভেনি। অসুস্থ শরীরেও তিনি কলম হাতে লিখে গেছেন, যেন মৃত্যুকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন- “তুমি তোমার সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করেছ, আর আমি তোমাকে আরও কাছে টেনেছি।”- এই একটি বাক্যই প্রমাণ করে, তাঁর কাছে মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়; বরং, এটি অনন্তের সঙ্গে মিলনের আরেক নাম। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ছায়ানট, বাংলা একাডেমি, এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠান যেসব অনুষ্ঠান করছে, তা কেবল একটি প্রথা পূরণ নয়-এটি আমাদের আত্মাকে পুনরুদ্ধারের এক আয়োজন। কারণ, রবীন্দ্রনাথের দিকে ফিরে তাকানো মানে নিজের শিকড়ে ফিরে যাওয়া; নিজের ভাষার সুবাস, নিজের সংস্কৃতির স্বরলিপি, নিজের ইতিহাসের ধ্বনি নতুন করে শোনা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন- যে মানুষ নিজের ভেতরের অন্ধকার চিনতে পারে, সেই-ই আলোর মূল্য বুঝতে পারে;যে জাতি নিজের ভাষাকে ভালোবাসতে শেখে, সেই জাতি অন্যের ভাষাকেও সম্মান করতে পারে; আর যে ভালোবাসা কেবল নিজের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, সেটিই মানবতার সর্বোচ্চ সাধনা। এই ২২ শ্রাবণে, আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক- আমরা যেন তাঁর গানের সুরে, তাঁর কবিতার আলোয়, তাঁর দর্শনের গভীরতায় নিজেদের জীবনের পথ খুঁজে নিতে পারি।রবীন্দ্রনাথ যেন আমাদের প্রতিটি স্বপ্নে, প্রতিটি সংগ্রামে, প্রতিটি প্রভাতের সূর্যোদয়ে নতুন করে জেগে ওঠেন। তাঁর মতো আমরা-ও যেন বলতে পারি— “জীবন যখন নিভে যাবে, তখনো আমার আলো থাকবে অন্যের চোখে”
কালের চিঠি ॥ গ্লোবাল ডেস্ক, যুক্তরাষ্ট্র
নিজস্ব প্রতিবেদক 





















