
ওয়াজেদ জীম : ২০১৬ সালে প্রথম ব্লগ লেখা শুরু করি এক বড়ভাইয়ের প্ররোচনায়। তখন ব্লগে অনেকেই অনেক কিছু লিখত আমি লিখতাম প্রেম নিয়ে। প্রেমের গল্প লিখি, প্রেমের চিঠি লিখি। ২০১৭ সালে লেখা শুরু করি চলচ্চিত্র পর্যালোচনা। একই বছর প্রথম রাজনৈতিক ব্লগ লিখি হলি আর্টিজন হামলা নিয়ে। আমার লেখার সারমর্ম ছিলো হলি আর্টিজনে হামলার কারণে জাকির নায়েকের দোষ কিভাবে থাকে? একটা ছবি দিয়ে কি দোষী সাব্যস্ত হয়? কেন তাকে ভারত বিতারিত করলো? সেই প্রথম। তারপর বড়ভাইদের সংস্পর্শে এসে নানাবিধ আলোচনা আমায় রাজনৈতিক লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করলো। ভারতের চন্দ্রীল ভট্টাচার্যের বক্তব্য বেশ ভালো লাগতো। কঠিন কোমল খোঁচা মারা বক্তব্য মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে লেখার পর প্রথমবার হুমকি পেলাম। যারা রাজনৈতিক লেখা লিখতে উৎসাহিত করতো তাদের কেউ কেউ বলল আমি বাড়াবাড়ি ধরণের লিখছি। এসব যেন বাদ দেই। পাকার আগে যেন পাকি। কিন্তু আমার নেশা লেগে গেছে। অন্যায় আমার কাছে অন্যায়। আমি অন্যায় নিয়ে লিখি। সেটা রাজনৈতিক সুতায় বাঁধা হলে আমার দোষ কোথায়? একটার পর একটা অন্যায় নিয়ে লিখতাম। কখনও কখনও লেখার জন্য অবশ্য ক্ষমাও চাওয়া লাগতো। ভয় যে লাগত না তা না ভয় হতো ভীষণ। সব সময় কি আর মুচলেকায় সাইন করা যায়? ২০১৯ এ এসে ফেসবুকেও লেখালেখি করি। ফেসবুকে লিখলে বিপদ বাড়ে বেশি। একদিন রাজনৈতিক পোস্ট করে চার পাঁচদিন চুপচাপ বসে থাকতে হয়। টানা লিখলে আইসিটি মামলা হয়। ঠিক সেই সময় এবং তারও আগে ২০১৬/২০১৭ সাল থেকেই দেখতাম রিফাত বিএনপির রাজনীতি করছে। রিফাত আমার থেকে বয়সে পাঁচ থেকে সাত বছরের ছোট, এলাকার ছোট ভাই এবং গার্লফ্রেন্ড তথা আমার সহধর্মিণীর বন্ধু। তাই সমীহ করে চলতাম। রাজনৈতিকভাবে অন্ধকার সেই সময় তখন যেসব কথা আমরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় থেকেও লিখতে ভয় পেতাম রিফাত পুরোপুরি ভিন্ন মতাদর্শের হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তা লিখে এবং বলে যেতো। বিএনপির মিছিল মাত্রই যখন কারাগারের নিশ্চিত টিকিট তখন রিফাত মিছিলের সামনের সাড়িতে থাকতো। ছোটখাটো শুকনা দেহের রিফাতকে একবার মারলে দ্বিতীয়বার মারার জায়গা যে দেহে নাই সেই দেহ নিয়া রিফাত কিভাবে রাজনীতি করে এটা নিয়ে মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করতাম। কখনও কখনও বিএনপির পরিচিত বড়ভাইদের কাছে জানতে চাইতাম, কি মনে করে রিফাতকে রাজনীতি করতে দিচ্ছেন? যেখানে আপনাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। প্রধান প্রধান নেতাদের নামে মামলা দিয়েছে, গুম করে রেখেছে। আপনাদের উচিত রিফাতকে বোঝানো। ওর ভবিষ্যত আছে। এখনও দুনিয়া দেখা বাকি। তারা বলত, রিফাত ভালো রাজনৈতিক হবে। সাহস আছে। বিএনপির সময় আসলে প্রাপ্য সম্মানটুকু পাবে। বাস্তবিকভাবে রিফাতের সাহস আছে। রাজনীতিতে শুধু সাহস থাকলেই হয় না। সাহসের পাশাপাশি থাকতে হয় মাথায় মগজ আর সেই মগজ ভর্তি ইতিহাস। রাজনৈতিক ইতিহাস, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনী। কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তা থেকেই সরাসরি এসব জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়। আবার কেউ কেউ পরিশ্রম করে। গাইবান্ধায় গেলে রিফাতের সাথে দেখা হলে কিছু বই পড়ার পরামর্শ দিতাম। পরেরবার গেলে দেখা শুনতাম পড়েছে কি নাহ, কেমন লাগলো, কি জানলো, কি বুঝলো না। সব জেনে আবার নতুন বইয়ের নাম বলতাম রিফাত পড়তো। কখনও কখনও রাতের বেলা ফোন দিয়ে বলতো, ভাই এই যে এই ঘটনা ঘটলো এইটা আপনি কেমনে দেখেন বা কেমনে বিশ্লেষণ করবেন? আমি আমার মতামত দিতাম। সে তার মতামত দিতো। সময়ের সাথে সাথে রিফাতকে নিয়ে সংকিত ছিলাম। কারণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে সরকার দলীদের কারো কারো নজরে চলে আসছিলো। যেহেতু গাইবান্ধায় সবাই প্রায় সবার পরিচিত তাই রিফাত নামটা বিরোধীদের মুখে রটেই গিয়েছিলো। দীর্ঘসময় এবং ছোট থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ সে অনেকটা বুঝে গিয়েছিলো। কিন্তু কথায় আছে রাজনীতি বোঝা এত সহজ নয়। রাজনৈতিক পাঠ চুকায় মৃত্যু হলে। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে দেশে এখন এক শতাংশ করে বিএনপি, এক শতাংশ জামায়াত, এক শতাংশ সমন্বয়ক ও এনসিপি, বাকী এক শতাংশ সাধারণ পাবলিক। দেশে আর আওয়ামী আর নাই। যারা আছে জেলে। রিফাত রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ কতটুকু শিখেছিলো জানি না। কয়েকদিন আগে গাইবান্ধায় গেলে ওর সাথে কথা হলো। বললাম, ‘এখন তো তোর অবস্থা ভালো হবার কথা। তোরা হচ্ছিস বিএনপির অসময়ের সম্বল। বিএনপির মাধ্যমেই তোদের বেড়ে ওঠা। যখন কেউ বিএনপি করার সাহস পেতে না তখন তোরা মিছিল করতি, শহর জুড়ে পোস্টার লাগাতি। এখন তো ভালো পর্যায়ে যাবি। দল তো তোদের মাথায় তুলে রাখবে!’ রিফাত আমার কথায় হাসলো। এতটা আহত হাসি আমি আশা করিনি। কারণ জানতে চাইলে জানালো, সে হাইব্রিড রাজনৈতিক শিকার। নব্য রাজনৈতিকদের কাছে পরাজয় হবে হবে ভাব। কিন্তু মনোবল আছে বলে হারিয়ে যাচ্ছে না। বিশ্বাস আছে। কিন্তু কতক্ষন রাখা সম্ভব? কত উড়ো খবর শোনা যায়! সেদিন কথা হলো অনেক সময়। দলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা জানালো। জানালো কিভাবে তাকে দূরে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে একদল। কিভাবে সে প্রতিনিয়ত পরাজিত হচ্ছে নব্য বিএনপির হাতে। বেশ দুঃখ করেই বলল, ‘এমন সময় রাজনীতি করছি যখন কেউ সাহস পেতো। বাড়িতে ঠিকঠাক সময় দিতাম না। ক্যারিয়ার নিয়া ভাবি নাই। কখনও ভাবি নাই গ্রেফতার যদি হই অথবা কেউ যদি কখনও কিছু করে তখন পরিবারের কি হবে? শুধু ভাবতাম দলের একদিন সুদিন আসবে তখন হয়তো কষ্ট লাঘব হবে। দল প্রাপ্য সম্মানটুকু দিবে। কিন্তু এখন তো দেখি এসবের কিছুই নাই। যা আছে তা হলো আশ্বাস। সবাই জানে কে কি করছে, কিন্তু ভাবখানা এমন ৫ আগস্টের পর তারা জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে গেছে। সব দেখে কষ্ট পাই কিন্তু দমে যাই না। আগে যেমন ছিলাম এখনও তেমনি। দল না বুঝুক। নিজের শান্তনা এই যে আমার আদর্শ থেকে আমি বিচ্যুত হই নাই। আমি আমার আদর্শে ঠিকঠাক।’ সেদিন বুঝলাম রাজনৈতিক দ্বিচারিতা। রাজনীতিতে উত্থান পতন ঘটে। কিন্তু পতনের মুখে কতজন দাঁড়িয়ে থাকে পতন ঠেকাতে? উত্থান শেষে যারা আসে তারা পতন আটকাতে পারে না। খাঁচার পাখি কি আর খোলা আকাশে উড়ার স্বাদ পায়? গাইবান্ধার রাজনীতিতে রিফাত পরিচিত মুখ। রিফাত তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যেন পায় এটাই কাম্য। একটা সত্য জানা উচিত, নদীতে জোয়ার আসে কিন্তু জোয়ার শেষে জমে থাকে পলি। জোয়ারে যা ভেসে আসে, জোয়ারেই তাকে টেনে নিয়ে যায়। রিফাত জোয়ার যাবার পর মাটি ভেদ করে ওঠা পলি। জোয়ার কখন আসলো কখন গেলো এসবে মাথা ব্যথা তার নেই। তবে পলি নিয়েই একসময় কারাকারি লাগে।
নিজস্ব প্রতিবেদক 

















