
কায়সার রহমান রোমেল: বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আজ এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ডিজিটাল বিপ্লব নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেও মফস্বলের সংবাদকর্মীরা রয়ে গেছেন চরম উপেক্ষিত। মফস্বল সংবাদকর্মীদের আইডি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে নামমাত্র সম্মানীতে এবং বিজ্ঞাপনের কমিশন কুড়িয়ে খাওয়ার প্রবণতা- মফস্বলের সাংবাদিকদের করুণ বাস্তবতারই এক তীক্ষ্ণ প্রতিচ্ছবি। এটি তাদের দীর্ঘদিনের শোষণ, অনিশ্চয়তা এবং বঞ্চনার গভীর ক্ষতকেই তুলে ধরে।
মফস্বল সংবাদকর্মীদের দুর্দশার মূল কারণ হলো তাদের পারিশ্রমিকের অভাব। অধিকাংশ সংবাদ সংস্থা তাদের একজন পূর্ণাঙ্গ সংবাদকর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, বরং তাদের ‘প্রতিনিধি’ বা ‘স্ট্রিংগার’ হিসেবে গণ্য করে। এর ফলে, তাদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন বা মাসিক সম্মানী থাকেনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য কিছু সম্মানী দেওয়া হলেও তা তাদের শ্রম ও সময়ের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। এই নামমাত্র সম্মানী দিয়ে জীবনযাপন করা তো দূরের কথা, বরং এটি সংবাদ সংগ্রহে ব্যয় হওয়া যাতায়াত ও অন্যান্য খরচও মেটাতে পারে না। তাই তাদের সাংবাদিকতার পাশাপাশি অন্য কোনো পেশা বেছে নিতে বাধ্য হতে হয়।
সংবাদমাধ্যমের পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড একজন সাংবাদিকের জন্য পেশাগত মর্যাদা ও সুরক্ষার প্রতীক। কিন্তু মফস্বলের অনেক সংবাদকর্মীর ক্ষেত্রে এই আইডি কার্ড যেন এক ধরনের শোষণের হাতিয়ার। আইডি কার্ডের বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হয় নিরলস শ্রম, অথচ এর পেছনে থাকে না কোনো আর্থিক নিশ্চয়তা। একটি পরিচয়পত্র হাতে দিয়ে তাদের বলা হয়, ‘আপনারা আমাদের প্রতিনিধি’। এই পরিচয়পত্রের বলে তারা সমাজে এক ধরনের সম্মানের অধিকারী হলেও, তাদের আর্থিক অবস্থা এবং জীবিকার অনিশ্চয়তা তাদের সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই আইডি কার্ডকে পুঁজি করে তারা সংবাদের পেছনে ছুটেন, কিন্তু দিন শেষে তাদের পকেটে থাকে কেবল শূন্যতা।
মফস্বলের সংবাদকর্মীদের দুর্দশার আরেকটি বড় দিক হলো বিজ্ঞাপনের কমিশন নির্ভরতা। অনেক সংবাদমাধ্যম মফস্বলের সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট কোনো সম্মানী না দিয়ে বিজ্ঞাপনের কমিশনের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে। এর ফলে, সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য—তথ্য পরিবেশন—প্রায়শই ব্যাহত হয়। একজন সংবাদকর্মী তখন সাংবাদিকের ভূমিকা ছেড়ে হয়ে যান একজন সেলসম্যান। বিজ্ঞাপনের খোঁজে তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, যা অনেক সময় তাদের পেশাগত নৈতিকতার সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করে। কে কতটা বিজ্ঞাপন আনতে পারল, তার ওপর নির্ভর করে তার আর্থিক সচ্ছলতা। এর ফলে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের মান হ্রাস পায় এবং সাংবাদিকতা তার নিরপেক্ষতা হারায়।
মফস্বলের সংবাদকর্মীদের এই দুর্দশার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যখন একজন সাংবাদিক তার পেশার প্রতি সম্মান এবং আর্থিক নিরাপত্তা পান না, তখন তার মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এর ফলে, অনেক যোগ্য ও মেধাবী সংবাদকর্মী এই পেশা ছেড়ে দেন। এর দীর্ঘমেয়াদি ফলস্বরূপ মফস্বলের সংবাদমাধ্যমে যোগ্য কর্মীর অভাব দেখা দেয়। একইসঙ্গে, যখন সাংবাদিকরা শুধুমাত্র আইডি কার্ড আর কমিশনের ওপর নির্ভর করে কাজ করেন, তখন সংবাদমাধ্যমগুলো নীতিহীন এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যায় এবং জনমত গঠনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন সংবাদমাধ্যমের মালিকপক্ষের নীতিগত পরিবর্তন। সংবাদমাধ্যমকে কেবল ব্যবসার উদ্দেশ্যে না দেখে, একে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মফস্বল সংবাদকর্মীদের জন্য উপযুক্ত বেতন কাঠামো, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। একইসঙ্গে, আইডি কার্ডকে কেবল পরিচয়পত্র নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও সম্মানির প্রতীক হিসেবে গণ্য করতে হবে। সংবাদকর্মীদের অবশ্যই বিজ্ঞাপনের কমিশন নির্ভরতার ফাঁদ থেকে বের করে এনে একটি সুস্থ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যথায়, মফস্বলের সাংবাদিকতার মান আরও নিচে নেমে যাবে এবং দেশের সংবাদমাধ্যম তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।
–
নিজস্ব প্রতিবেদক 





















