
ওয়াজেদ হোসেন জীম:
যখনই যা ইচ্ছে হলো বলে ফেলতে নেই।
ইচ্ছে আপনার করবে
জ্বিবটা উসখুস করবে
গলার ভেতরটা কুটকুট করে উঠবে
তবু বলতে নেই।
(শুভদাস গুপ্ত)
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্যার — তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে, বাক স্বাধীনতা আছে। তিনি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতেই পারেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে, খাবার টেবিলে, টয়লেটে গিয়ে, বিকালে চায়ের আড্ডায়, সন্ধ্যায় ক্লাবে, রাতে সহবাস শেষে ঘুমানোর আগে তিনি আওয়ামী লীগের মা—বাপ এক করে দিতে পারেন, গালিগালাজ করতে পারেন। গালি দিয়ে দিয়ে একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার। প্রত্যেক বাংলাদেশীর এই অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু ২০২৪ সালের তুলনায় ১৯৭১ তেমন কিছুই হয় নাই — এই কথাটুকু তিনি বলতে পারেন না। একদম বলতে পারেন না। এটা ব্যক্তি অধিকার অথবা বাক অধিকারের আওতাভুক্ত নয়। এসব জাতীয় ব্যাপার। ধ্রুব সত্যের মতো।
১৯৭১ সালে কিছু না হলে ২০২৪ এ এতগুলো প্রাণ যেতো না। কারণ তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতো না। ৭১ সালে কিছু না হলে তাঁর সহধর্মিণী শিলা আহমেদ তাঁর সাথে থাকতেন না। কারণ হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেন কিনা অথবা থাকলেও এত জনপ্রিয় হতে পারতেন কি না তাও বলা মুশকিল এবং ৭১ সালে কিছু না হলে তিনিও উপদেষ্টা হতে পারতেন না। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ — একই সুতায় বাঁধা গিট। ২৪ এর দোহাই দিয়ে ৭১ টেনে এনে খুব সুক্ষ্মভাবে কাউকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা যুক্তিযুক্ত নয়। আওয়ামী বিরোধী মাত্রই যে তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করবে, পাকিস্তানীদের মাথা ঠুকবে, ৭১ ভুলে যাবে— কারো কারো এটা মাথা থেকে পুরোদমে ঝেড়ে ফেলা উচিত। জাতীয়তাবোধ আর জাতীয় রাজনীতি দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়।
২০২৪ এ যেমন কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে সারাদেশের জনগণ এক হয়েছিল তেমনি ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগে লাগাতার আন্দোলনের কারণেই পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের মানুষ হত্যা শুরু করে এবং দেশের জনগণ তখন পাকিস্তানীদের প্রতিহত করতে একসাথে হয়ে লড়াই করে, জীবন দেয়। আওয়ামী লীগের আন্দোলন না থাকলে কখনোই পাকিস্তানীরা ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশের মানুষ হত্যাযজ্ঞ মিশনে নামতো না — এই ইতিহাসটুকু পরিষ্কার এবং মিমাংসিত। ইতিহাস বলে যেকোন গণআন্দোলন অথবা গণঅভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে রাজনীতি আন্দোলনের মাধ্যমেই। এজন্যই ১৯৭১ যেমন সত্য, তেমনি সত্য ২০২৪। প্রেক্ষাপট এবং শত্রু পক্ষ ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু ক্ষত থেকে রক্ত ঝরা কখনই বন্ধ হবে না। টাইম ডিসটেন্স বলে এখানে কোন কিছু নেই, থাকতে পারে না।
১৯৭১ সালে জনসাধারণের অংশগ্রহণে জনগণের ত্যাগের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতার আসার পর পর তাদের কারো কারো চেহারার পরিবর্তন হয়। জনগণের চাওয়া পূরণ তো দূরের কথা জনগণের চাওয়া কি তাও শোনার সময় কেউ কেউ পেতো না। কিছু কিছু ক্ষমতালোভী ও অতি উৎসাহী নেতা—কর্মীদের কারণে জনসাধারণ থেকে আওয়ামী লীগের দুরত্ব বাড়ে। বাড়তে বাড়তে বিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনীর নামেও অসত্য গালগল্প রটিয়ে বেড়ায় একদল, সেনাবাহিনীর গুরুত্ব কমে যায়। ফলে সেনাবাহিনীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং আওয়ামী লীগ প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারসহ জাতীয় চারনেতাদের হত্যা হয়।
২০২৪ এর আন্দোলনের পরেও অনুরূপ দেখা যাচ্ছে। বিজয় শেষে এক নিদিষ্ট শ্রেণী বাগানের মধু খাচ্ছে । আর সিংহভাগ জনগণ বাগানের মধু খাওয়া তো দূরের কথা তারা বাগান দেখার সুযোগটুকু পাচ্ছে না। জয় পূর্ববতী আশ্বাস যা ছিলো, তা ধোঁয়াশা। জনগণের চাওয়া অনুযায়ী কাজ এবারেও হচ্ছে না। ক্ষমতা পেয়ে পোষাক পরিবর্তন করে একেকজন হয়ে গেছে আকাশের তারা। দেখা যায় জ্বলছে কিন্তু সেই আলোতে জনগণের ঘর আলোকিত হয় না। দুরত্ব বাড়তে বাড়তে জনমনে বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীকে নিয়েও অতিরঞ্জিত, অসত্য গালগল্প প্রচারে তাঁরাও ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যত কি হবে তা বলা যায় না।
২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের ৭১ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা অনেকটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তা না করে ক্ষমতায় বসেই কেউ কেউ ৭১ নিয়ে সমালোচনা করছে। ২০২৪ এ ৩৬ দিনে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী শহিদ হলে ১৯৭১ সালে নয়মাসের যুদ্ধে কতজন সাধারণ মানুষ, শিশু, মা—বোন শহীদ হয়েছে তার হিসাব কেউ মনে রাখে না অথবা করেও না। হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতার চেয়ারে বসলে মানুষ সুলভ আচরণে যা কিছুই বলতে ইচ্ছে তাই তারা বলছেন, যা করতে ইচ্ছে করে তাই তারা করছেন। রাজা এবং প্রজা প্রথা ফিরিয়ে হয়তো তারা বদ্ধ পরিকর।
পরিশেষে, ১৯৭১ এবং ২০২৪ দুই ধ্রুব সত্য। একটির সাথে আরেকটির তুলনা নয়। কোনটিকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকতে এই দুই সত্য ততদিন বাংলাদেশ নিজ বুকে আগলে রাখবে।
উল্লেখ্য, অন্তবর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত ২৮ জুলাই ২০২৫ সকালে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে জুলাই গণহত্যা বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন — ‘শেখ হাসিনা ও তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও মনে হয় এত জঘন্য অপরাধ করেনি।’
নিজস্ব প্রতিবেদক 
















