
ওয়াজেদ হোসেন জীম: গোপালগঞ্জ আওয়ামীলীগের তীর্থ স্থান। শেখ মুজিবর রহমানের জন্মস্থানের পাশাপাশি তার সমাধিও সেখানে। শেখ হাসিনা দীর্ঘ পনেরো বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিজ এলাকায় তার প্রভাব সারাদেশের থেকেও বেশি। ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট ভারতে না গিয়ে তিনি গোপালগঞ্জে গেলেই বেশি ভালো করতেন — এমন মন্তব্যও শোনা যায়। তথ্য মতে, শেখ হাসিনা তার শাসনামলে গোপালগঞ্জকে শক্তিশালী রাখতে সরকারের সকল শাখায় গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া তার ও আওয়ামীলীগের অতি ভক্তদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। বিশেষ করে প্রশাসনখাতে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, বিচারপতি, নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট, উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব — প্রশাসনের এহেন কোন কিছু নাই যেখানে গোপালগঞ্জের লোক নাই। আওয়ামী আমলে এইসকল নিয়োগ কিভাবে হতো তা তো সকলের জানা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সাবেক র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীরের বাড়িও গোপালগঞ্জ। শেখ মুজিবর রহমানের আমল থেকেই গোপালগঞ্জে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ সুবিধা করতে পারে নাই। লাভের থেকে তাদের লসের পরিমান বেশি। অর্থ ব্যায় ছাড়া আর কিছু নয়। সভা মিছিলে কিছু উৎসাহী লোক যায়, স্লোগান দেয়, গলা পাটায়, খাবাবের প্যাকেট নিয়ে চলে এসে ঘুমানোর আগে মুজিবের নাম জবে। গোপালগঞ্জ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লেখা ‘লালসালু’ উপন্যাসের মহব্বতনগর গ্রামের মতো। সবুজশ্যামল গাছে ঘেরা। হঠাৎ একজনের আগমন হয় নাম ‘মজিদ’। মজিদ আসার পর কাকতালীয়ভাবে বদলে যায় অনেক কিছু। পুরো গ্রাম মজিদের কথা মানতে শুরু করে। মজিদ এবং মজিদের কথা হয়ে যায় ধ্রুব সত্য। রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের আগমেন পর তার নামের পাশাপাশি গোপালগঞ্জের নাম ও মান বাড়তে থাকে। ঘনিষ্ট কারও কারও জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তার মৃত্যুর পর পরিবারের বাকীদের ঢাকার কবরস্থ করলেও, তাকে গোপালগঞ্জেই দাফন করা হলো। পরবতীর্তে চারবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলেন। বলতে গেলে এইসময়েই বিশাল পরিবর্তন আসলো গোপালগঞ্জে। তারা বিশ^াস করা শুরু করলেন আওয়ামীলীগ মানেই গোপালগঞ্জের উন্নতি। একজন ভ্যানওয়ালাও সেখানে বিমানবাহিনীতে চাকুরি পেতে পারে। মহব্বতনগর গ্রামের মতো গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবর রহমান ও শেখ হাসিনা মজিদের মতো ধ্রুব সত্য হয়ে উঠলেন। পাশাপশি সেখানে ঘরে ঘরে চাকুরি দেবার এবং কেউ কেউ কোটি কোটি টাকার মালিক হবার কারণে একটা অন্ধ মুরিদ শ্রেণী তৈরি হয়ে যায় শেখ হাসিনার তথা আওয়ামীলীগের। বার্ষিক ওরশের মতো তারাও সময়ে সময়ে জেগে ওঠে। বিশেষ করে আওয়ামী বিপক্ষদলের কেউ সেখানে রাজনৈতিক সভা অথবা মিটিং—মিছিলে উদ্দে্যশে সেখানে যায়।
গত ১৬ জুলাই ২০২৫ এ জাতীয় নাগরিক পার্টি — এনসিপি’এর নেতাকমীর্রা গোপালগঞ্জে গিয়েছিলেন পথসভা করতে। সেখানে যাবার আগে থেকেই নানাবিধ আলোচনা হচ্ছিল। তারা সেখানে সভা করতে পারবেন না, আওয়ামীলীগ তাদের প্রতিহত করবে, একটা বড়ধরণের সহিংসতার আশাংকা কেউ কেউ করছিলেন। কিন্তু এনসিপির জনসমর্থন দরকার ছিলো। গোপালগঞ্জে একটা অঘটন ঘটলে তারা বৃহৎ একটা জনসমর্থন পাবে এই আশায় তারা সকল বাধা এবং অনুমান দূর করে গোপালগঞ্জে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাবার আগের দিন নিশ্চিতভাবে যাতে কিছু ঘটে তার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানির জন্য ‘মার্চ ফর গোপালগঞ্জ’ ঘোষণা করে। পরেরদিন সকাল থেকেই গোপালগঞ্জে থাকা আওয়ামীলীগের মুরিদরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। পুলিশ, ইউএনওসহ প্রশাসনের বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেয়। দুপুর নাগাদ দেশের ইতিহাসে সব্বোর্চ নিরাপত্তা নিয়ে এনসিপির নেতাকমীর্রা গোপালগঞ্জে যায়। সাংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি তারা নিজেরাও ফেসবুক লাইভে এসে অবস্থান জানাচ্ছিলো। তাদের সমর্থিত কেউ কেউ আবার উস্কানিমূল ফেসবুক পোস্ট এবং বক্তব্য প্রচার করছিলো। সার্বিক পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছিলো, কেউ কেউ চাচ্ছে একটা বড় ধরণের সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়া যায় কিনা। অন্যদিকে একদল আওয়ামীলীগের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের জন্য তৈরি হচ্ছিলো। যেন আজ হেরে গেলে ধর্মের খাতা থেকে নাম কাটা যাবে। এনসিপির সভার মাঝখানে তারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। কলকাতা অথবা ভারতের অন্য কোন শহরের এসি রুমে বসে আওয়ামীলীগের প্রধান নেতারা তালি দিয়ে ওঠে। লাঠি, ইট পাটকেল, দেশীয় অস্ত্র, কেউ কেউ পিস্তল নিয়ে চলে আসে। পুলিশ দ্রুত এনসিপি নেতাদের স্থানীয় এসপি অফিসে আশ্রয় দেয়। পুুলিশ এবং গোপালগঞ্জ আওয়ামীলীগের সংঘর্ষ চলতেই থাকে। দুইপক্ষের লোকজন আহত হয়। নিহত হয় গোপালগঞ্জের উৎসাহী চারজন আওয়ামীলীগ। পরিস্থিতি অবনতি হলে সেনাবাহিনী পুলিশকে সহযোগিতায় চলে আসে। তারা মাঠে নামে। গুলি চালায়, গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, লাঠি চার্জ করে। কিন্তু পরিস্থিতি আশানুরুপ নিয়ন্ত্রণে আসে না। সময় বাড়তে থাকে, দিনের আলো কমতে থাকে। ধাওয়াপাল্টা ধাওয়া অপরিবর্তনশীল। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে এনসিপির নেতারা। একপর্যায়ে সরকারের কারো নিদের্শেই সেনাবাহিনীর আমার্র্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) গাড়িতে করে কঠোর নিরাপত্তায় এনসিপির নেতাদের গোপালগঞ্জে থেকে বের করে আনা হয়। পরবতীর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর আমার্র্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার করা হয়। এটি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি যানবাহন। যা অনেকটা যুদ্ধযান ট্যাংকের মতো দেখতে।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় এনসিপি সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ করে। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গোপালঞ্জের নাম পরিবর্তন করার কথা বলে, কেউ কেউ গোপালগঞ্জ জেলা ভাগ করে দেবার কথা বলে। এনসিপির যেসব নেতারা যুদ্ধযানে করে গোপালগঞ্জ ত্যাগ করে তারা জানায়, গোপালগঞ্জ নিয়ে যে মিথ যে তারা সব মিথ ভেঙ্গেছে। তারা গোপালগঞ্জ গিয়ে অসমাপ্ত সভা করে যুদ্ধযানে ফিরে তারা প্রমাণ করতে চায় গোপালগঞ্জে আওয়ামীলীগের বাহিরেও রাজনীতি করা সম্ভব। গোপালগঞ্জ শুধু আওয়ামীলীগের না। ভবিষ্যতে গোপালগঞ্জ তাদের দখলে চলে যাবে।
বাস্তবিক সত্য এই যে, গোপালগঞ্জ নিয়ে এতদিন যে মিথ তা সত্য হয়ছে। আওয়ামীলীগের তীর্থস্থান যে গোপালগঞ্জ তা প্রমাণ হয়েছে অসমাপ্ত সভা করে ফেরার সময় সুরক্ষিত সেনাবাহিনীর যুদ্ধযান ব্যবহারের মাধ্যমে। পুরো দেশবাসী বিশ^াস করে, এনসিপি বর্তমান সরকারের ছায়া। কিছু কিছু সময় তারাই সরকারের মাথা, হাত—পা, মগজ, বৃক্ক। তাদের নিরাপত্তায় পুরো সেনাবাহিনী প্রয়োজনে গোপালগঞ্জে যাবে, বিমানবাহিনীর সকল বিমান আকাশে উড়বে, নৌবাহিনী ট্রাকে করে সাবমেরিন নিয়ে রওনা নিবে। কিন্তু সাধারণ বিপক্ষ দল তো এত সুবিধা পাবে না। তাদের নিরাপত্তা কে দিবে? এহেন ঘটনায় মোটামুটি সকল রাজনৈতিক দলের বুকের একছটাক হলেও পানি শুকিয়ে গেছে। যারা গোপালগঞ্জে সভা করবে ভেবেছিলো তারা দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবে।
গোপালগঞ্জে এনসিপি সভা করে জনসমর্থন লাভের যে আশা করেছিলো, সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে আওয়ামীলীগের লাভ হলো অপরিসীম। শেখ হাসিনা বিগত পনেরো বছর গোপালগঞ্জকে যেভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েও পারে নি, এনসিপি সেই গোপালগঞ্জকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। দিনশেষে লাভ আওয়ামীলীগেরই হলো। রটে গেলো একটি কথা, গোপালগঞ্জে থেকে ফিরতে হয় সেনাবাহিনীর আমার্র্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) যুদ্ধযানে করে। গোপালগঞ্জ আওয়ামীলীগের তীর্থ স্থান।
নিজস্ব প্রতিবেদক 




















