মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসরাইলি হামলায় নিহত গাজার শিশু সংবাদকর্মী ইয়াকিন

মাত্র ১১ বছর বয়সি ইয়াকিন হাম্মাদ গাজার বাস্তুচ্যুত ও এতিম শিশুদের জন্য প্রতিরোধ ও আশার আলো হয়ে উঠেছিল। বয়সের তুলনায় বেশি জ্ঞানের অধিকারী ইয়াকিন অল্প বয়সেই সংবাদ সংগ্রহে কাজ শুরু করে। এজন্য গাজার সর্বকনিষ্ঠ সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচিতি পায়। পাশাপাশি স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থার স্বেচ্ছাসেবকও ছিল সে

অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও মানসিক আঘাতের মধ্যে বেড়ে ওঠা ইয়াকিন প্রায়ই তার বড় ভাই মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ হাম্মাদের সাথে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিত। গণহত্যার মধ্যে সীমাহীন সাহস ও ধৈর্যের সাথে শিশুদের খাবার, পোশাক ও খেলনা বিতরণ করত।
 
ইয়াকিন গাজার মানবিক সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করত। সে তার ইনস্টাগ্রাম ভিডিওগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। কোনো ভিডিওতে এতিম ও বাস্তুচ্যুত শিশুদের জন্য তার নানা ধরনের সহায়তা কার্যক্রম তুলে ধরা হত।
আবার কোনো ভিডিওতে তাকে শিশুদের সাথে হাসতে ও খেলতে এবং আনন্দের সাথে উপহার বিতরণ করতে দেখা যেত। অনেক ভিডিওতেই ইসরাইলি বোমাবর্ষণের মধ্যে গাজাবাসীর দৈনন্দিন জীবনের নানা সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হত। ইয়াকিনের এসব কর্মকাণ্ড এবং তার উপস্থাপন হয়ে ওঠে ইসরাইলি গণহত্যার মধ্যেও মাটি কামড়ে টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক।
 
যেমন সে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা তার এক ভিডিওতে লিখেছিল, ‘আমরা এখনও দুর্ভিক্ষ, অবরোধ ও চলমান গণহত্যা সত্ত্বেও আল কোরআনের শিক্ষা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে আছি, খালি পেটে ও বিশ্বস্ত হৃদয়ে।’ 
 
গত শুক্রবার (২৩ মে)  রাতে ইয়াকিনের সেই কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহর আল-বারাকা এলাকায় বোমা হামলা চালানো হলে ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় সে।
যে মেয়ে শিশুটি একসময় আরও হাজার হাজার শিশুর জন্য সান্ত্বনা ও হাসি নিয়ে এসেছিল, সে গাজায় ক্রমবর্ধমান প্রাণহানির তালিকায় আরেকটি নাম হয়ে উঠলো। তার মৃত্যুতে উপত্যকার সবচেয়ে কম বয়সি ও সাহসী কণ্ঠস্বরের মৃত্যু হলো।
 
 
ছোট্ট এই ফিলিস্তিনি শিশুর শাহাদাতের খবর দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিবেকবান মানুষের মধ্যে শোক ও ক্রোধের সৃষ্টি করে। অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডকে ইসরাইলি সরকারের সেই ধারাবাহিক গণহত্যার অংশ হিসেবে দেখছেন, যা মাসের পর মাস ধরে গাজার নিরপরাধ শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
 
তার মৃত্যুর পর সারাবিশ্বের বহু মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী শোক প্রকাশ করেছেন এবং গাজা উপত্যকায় বর্বর ইহুদিদের চলমান আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একজন লিখেছেন, ‘সে এমন একটি শিশু যার স্কুলে থাকার কথা ছিল। যেখানে অন্য সব জায়গার মতো শিশুরা আনন্দে খেলা করে।’
 
তার বড় ভাই মাহমুদ লিখেছেন, ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইয়াকিন আমার বোন, আমার আত্মা, শহীদ হয়েছেন’। ইয়াকিনের পাশাপাশি সেদিন গাজাজুড়ে আরও অন্তত ৭৬ জন নিহত হয়। যার মধ্যে বিলাল আল-হাতুম নামে এক সাংবাদিকও ছিলেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা তার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাক্ষী। একাধিক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের টার্গেট করছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার এই নৃশংসতার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু এসব নিন্দা কখনোই গাজার নিরস্ত্র শিশুদের হত্যা থামাতে পারেনি।
 
ইয়াকিন হাম্মাদও সেই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশুর দলে যোগ দিল যাদের স্বপ্ন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে। সে এখন আর তার সমবয়সীদের জন্য চিৎকার করে ডাক দিতে পারবে না। কিন্তু তার নাম এখন প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হলো। 

জনপ্রিয়

ইউথ ক্লাইমেট স্মল গ্র্যান্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল সৃজনশীল গাইবান্ধা  

ইসরাইলি হামলায় নিহত গাজার শিশু সংবাদকর্মী ইয়াকিন

প্রকাশের সময়: ০১:২৪:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

মাত্র ১১ বছর বয়সি ইয়াকিন হাম্মাদ গাজার বাস্তুচ্যুত ও এতিম শিশুদের জন্য প্রতিরোধ ও আশার আলো হয়ে উঠেছিল। বয়সের তুলনায় বেশি জ্ঞানের অধিকারী ইয়াকিন অল্প বয়সেই সংবাদ সংগ্রহে কাজ শুরু করে। এজন্য গাজার সর্বকনিষ্ঠ সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচিতি পায়। পাশাপাশি স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থার স্বেচ্ছাসেবকও ছিল সে

অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও মানসিক আঘাতের মধ্যে বেড়ে ওঠা ইয়াকিন প্রায়ই তার বড় ভাই মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ হাম্মাদের সাথে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিত। গণহত্যার মধ্যে সীমাহীন সাহস ও ধৈর্যের সাথে শিশুদের খাবার, পোশাক ও খেলনা বিতরণ করত।
 
ইয়াকিন গাজার মানবিক সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করত। সে তার ইনস্টাগ্রাম ভিডিওগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। কোনো ভিডিওতে এতিম ও বাস্তুচ্যুত শিশুদের জন্য তার নানা ধরনের সহায়তা কার্যক্রম তুলে ধরা হত।
আবার কোনো ভিডিওতে তাকে শিশুদের সাথে হাসতে ও খেলতে এবং আনন্দের সাথে উপহার বিতরণ করতে দেখা যেত। অনেক ভিডিওতেই ইসরাইলি বোমাবর্ষণের মধ্যে গাজাবাসীর দৈনন্দিন জীবনের নানা সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হত। ইয়াকিনের এসব কর্মকাণ্ড এবং তার উপস্থাপন হয়ে ওঠে ইসরাইলি গণহত্যার মধ্যেও মাটি কামড়ে টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক।
 
যেমন সে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা তার এক ভিডিওতে লিখেছিল, ‘আমরা এখনও দুর্ভিক্ষ, অবরোধ ও চলমান গণহত্যা সত্ত্বেও আল কোরআনের শিক্ষা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে আছি, খালি পেটে ও বিশ্বস্ত হৃদয়ে।’ 
 
গত শুক্রবার (২৩ মে)  রাতে ইয়াকিনের সেই কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহর আল-বারাকা এলাকায় বোমা হামলা চালানো হলে ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় সে।
যে মেয়ে শিশুটি একসময় আরও হাজার হাজার শিশুর জন্য সান্ত্বনা ও হাসি নিয়ে এসেছিল, সে গাজায় ক্রমবর্ধমান প্রাণহানির তালিকায় আরেকটি নাম হয়ে উঠলো। তার মৃত্যুতে উপত্যকার সবচেয়ে কম বয়সি ও সাহসী কণ্ঠস্বরের মৃত্যু হলো।
 
 
ছোট্ট এই ফিলিস্তিনি শিশুর শাহাদাতের খবর দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিবেকবান মানুষের মধ্যে শোক ও ক্রোধের সৃষ্টি করে। অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডকে ইসরাইলি সরকারের সেই ধারাবাহিক গণহত্যার অংশ হিসেবে দেখছেন, যা মাসের পর মাস ধরে গাজার নিরপরাধ শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
 
তার মৃত্যুর পর সারাবিশ্বের বহু মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী শোক প্রকাশ করেছেন এবং গাজা উপত্যকায় বর্বর ইহুদিদের চলমান আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একজন লিখেছেন, ‘সে এমন একটি শিশু যার স্কুলে থাকার কথা ছিল। যেখানে অন্য সব জায়গার মতো শিশুরা আনন্দে খেলা করে।’
 
তার বড় ভাই মাহমুদ লিখেছেন, ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইয়াকিন আমার বোন, আমার আত্মা, শহীদ হয়েছেন’। ইয়াকিনের পাশাপাশি সেদিন গাজাজুড়ে আরও অন্তত ৭৬ জন নিহত হয়। যার মধ্যে বিলাল আল-হাতুম নামে এক সাংবাদিকও ছিলেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা তার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাক্ষী। একাধিক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের টার্গেট করছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার এই নৃশংসতার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু এসব নিন্দা কখনোই গাজার নিরস্ত্র শিশুদের হত্যা থামাতে পারেনি।
 
ইয়াকিন হাম্মাদও সেই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশুর দলে যোগ দিল যাদের স্বপ্ন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে। সে এখন আর তার সমবয়সীদের জন্য চিৎকার করে ডাক দিতে পারবে না। কিন্তু তার নাম এখন প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হলো।