বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গম্ভীরা: সময়ের সুরে হারিয়ে যাওয়া এক আর্তনাদ

আহমেদ শাহেদ : বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি সুর, প্রতিটি ছন্দ, যেন এ দেশের প্রাণের আরেক ভাষ্য। সেইসব হারানো ভাষ্যের ভেতর গম্ভীরা এক অনন্য নাম। রাজশাহী অঞ্চলের বুক চিরে উঠে আসা গম্ভীরা গান শুধু সঙ্গীত নয়, সময়ের কথা বলা এক বিশেষ মাধ্যম, যেখানে হাসির ছলে বলা হয় সমাজের নানা গূঢ় সত্য, লোকজ বেদনা আর বিদ্রূপের নিখুঁত চিত্র। সময়ের আবর্তে আজ সেই গম্ভীরা হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই স্মৃতি, সেই অতীতের ধ্বনি আজও মনে বয়ে আনে অদ্ভুত এক হাহাকার।

 

গম্ভীরা শব্দের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে নানা মত। কেউ বলেন, ‘গম্ভীর’ শব্দ থেকেই এর জন্ম – যার অর্থ গভীর বা প্রকাণ্ড। আবার কেউ বলেন, গম্ভীর মুখ করে সমাজের সংকট নিয়ে গান গাওয়ার কারণেই নাম হয়েছে গম্ভীরা। মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চল গম্ভীরা গানের মূল আবাসভূমি। প্রাচীনকাল থেকে মঙ্গলকামনায়, সামাজিক অনুশাসনের বার্তা ছড়াতে, মানুষের মনের কথা রাজসভার দরবারে তুলতে গম্ভীরা ব্যবহৃত হতো। সময়ের পরিক্রমায় সেটি হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মুখপত্র। গান, ছড়া, কথোপকথন- সব মিলিয়ে এক অভিনব নাটকীয়তায় গম্ভীরা আজও বেঁচে আছে কিছু মানুষের স্মৃতিতে।

 

গম্ভীরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর উপস্থাপনভঙ্গি। সাধারণত দুইজন চরিত্র- নানা ও নাতি- দ্বিমুখী কথোপকথনের মাধ্যমে গম্ভীরা পরিবেশন করেন। নানা চরিত্রটি অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী, আর নাতি হলো কৌতূহলী ও প্রশ্নবাণে ভরা। নানা ব্যাখ্যা করেন, নাতি প্রশ্ন করে- এই দ্বন্দ্বের মাঝেই ফুটে ওঠে সমাজের চিত্র, মানুষের মনের কথা। মাঝে মাঝে চরিত্র বাড়তে পারে, বিষয়ভেদে পরিবেশনা হতে পারে আরও বড়, তবে মূল রূপ এই দ্বিপাক্ষিক আলাপেই আটকে আছে।

 

প্রচলিত বিশ্বাস, এই গম্ভীরা গানের বয়স প্রায় ৬০০ বছর। বাংলার সুলতানি আমলের রাজপ্রাসাদেও এর চর্চা ছিল। মুঘল আমলেও নাকি স্থানীয় পরগণার রাজা-মহারাজাদের মজলিশে গম্ভীরা পরিবেশিত হতো। তখন গম্ভীরা ছিল রাজকীয় বিনোদন, পরে গ্রামবাংলার মানুষ তাকে আপন করে নেয়। ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক পরব, নবান্ন উৎসবেও গম্ভীরা হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

এখানেই এসে পড়ে ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা। আজ থেকে প্রায় দশ-বারো বছর আগে, পেশাগত কাজে রাজশাহী গিয়েছিলাম। তখন আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতাম। দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলায় এক স্থানীয় মেলার মধ্যে গম্ভীরা গান দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আলোর ঝলকানি নেই, নেই বড় মঞ্চের আয়োজন-তবে সেই মাটির গন্ধমাখা পরিবেশ, সেই কথার স্রোত যেন হৃদয়ে শেকড় গেড়ে বসেছিল। তখনই প্রথম বুঝেছিলাম, কেবল গান নয়, গম্ভীরা হচ্ছে এক জীবন্ত ইতিহাস। চরিত্ররা সমাজের সমস্যা নিয়ে খুনসুটি করে কথা বলছে, আবার কোথায় যেন গভীর আর্তি- এক টুকরো মাটির রোদন। সেই মুহূর্ত আজও ভুলতে পারিনি।

 

কিন্তু তারপর? তারপর আর কখনো গম্ভীরা শোনা হয়নি। যদিও কাজের সূত্রে নানা এলাকায় যাওয়া হয়েছে, গম্ভীরা যেন কোনো হারানো সুরের মতো অধরা থেকে গেছে। এর একটা কারণ হয়তো আমার জন্মস্থান। আমি চাঁদপুরের মানুষ। চাঁদপুরে, কিংবা আশপাশের অঞ্চলে, গম্ভীরা তেমন প্রচলিত নয়। আর অন্য বড় কারণ হলো-গম্ভীরা সহ অনেক লোকগানেরই দিন দিন অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। শহুরে ব্যস্ততা, প্রযুক্তির অজস্র বিকল্প আর বাণিজ্যিক বিনোদনের দাপটে এই ধারা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

 

এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামে-গঞ্জে বাড়ি বাড়ি গম্ভীরার আসর বসতো। গাজনের সময়ে, চৈত্র সংক্রান্তির রাতে, মানুষের মুখে মুখে ফিরতো নানা গম্ভীরা দল। এখন সেই দৃশ্য প্রায় অতীত। ক’জন যুবকই বা আজ আর হাতে তাল, বাঁশি, ঢোল নিয়ে গম্ভীরা রপ্ত করতে চায়? লোকায়ত সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ কমে এসেছে, জীবনযাত্রার গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি মাটির সেই টান।

 

গম্ভীরা শুধু গান নয়, ছিল সচেতনতার হাতিয়ারও। ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি নিপীড়ন, কৃষকের দুর্দশা-সবকিছু নিয়ে গম্ভীরার ছন্দে প্রতিবাদ গাঁথা হতো। তখনকার শিল্পীরা ছিলেন জনতার কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার পরেও গম্ভীরার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষ তাদের সংকট, আশা-নিরাশার কথা বলতো। আজকের দিনে সেই শক্তিমান ধারাটা অনেকটাই বিবর্ণ। কিছু সংগঠন চেষ্টা করছে গম্ভীরাকে টিকিয়ে রাখতে, তবে তা বেশিরভাগ সময়ই সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। মূলধারার প্রচারে গম্ভীরা আজও অনুপস্থিত। মিডিয়ার চোখে সেটা যেন অনাকর্ষণীয় এক ঐতিহ্য মাত্র।

 

তবুও আশার আলো ফুরিয়ে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নাটোরের কিছু সংগঠন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আজও গম্ভীরার চর্চা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হচ্ছে, তরুণ শিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগ বাড়ে, যদি মিডিয়া একটু বেশি মনোযোগ দেয়, তবে হয়তো গম্ভীরা আবারও ফিরে পাবে তার হারানো কণ্ঠস্বর।

 

গম্ভীরার এই সংকটের পেছনে দায়ী একদিকে প্রযুক্তি ও সময়ের পরিবর্তন, আবার অন্যদিকে আমাদের নিজেদের অবহেলা। আমরা যারা মাটির সুর ভালোবাসি, তারা যদি একটিবার করে ভাবি-আমাদের আগামীর প্রজন্ম কি গম্ভীরার কথা জানবে? জানবে এই দেশজ সাংস্কৃতিক রত্নের কথা? যদি না জানে, তবে ইতিহাসের এই পাতাটি হয়তো চিরতরে মুছে যাবে।

 

গম্ভীরা আমাদের শুধু আনন্দ দেয় না, শেখায়। শেখায় হাসির ছলে কথার গভীরতা ধরতে, শেখায় সংকটের মধ্যেও প্রতিবাদী হতে, শেখায় সমাজের মুখপত্র হয়ে উঠতে। তাই গম্ভীরা শুধু মঞ্চের গান নয়, এটি হলো সময়ের রক্তমাখা আর্তনাদ, একটি জাতির শিকড়ের ভাষ্য। আমাদের দায়িত্ব এই শিকড়টিকে টিকিয়ে রাখা, বাঁচিয়ে রাখা।

 

আজ যখন কোনো মেলায়, কোনো গ্রামীণ আড্ডায় গম্ভীরার সুর ভেসে আসে দূর থেকে, মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনে হয়, হয়তো এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো কোনো গৃহস্থ বাড়ির উঠানে ঢোলের শব্দে বাঁধা পড়ে আছে সেই হারানো রাত্রির গান। এখনো কোনো নাতি প্রশ্ন করে, কোনো নানা উত্তর দেয়-সময়ের গম্ভীর ভাষ্যে।

 

তাই আসুন, নতুন করে ভালবাসি গম্ভীরাকে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে, সময়ের ধুলো ঝেড়ে, ফিরে যাই মাটির সেই ঘ্রাণে, সেই সুরের কাছে-যেখানে গম্ভীরা আজও বেঁচে আছে মৃদু কণ্ঠে, গোপন ভালোবাসায়।

 

লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী।

 

ছবি: সংগৃহিত।

জনপ্রিয়

ইউথ ক্লাইমেট স্মল গ্র্যান্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল সৃজনশীল গাইবান্ধা  

গম্ভীরা: সময়ের সুরে হারিয়ে যাওয়া এক আর্তনাদ

প্রকাশের সময়: ১২:৩২:২০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

আহমেদ শাহেদ : বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি সুর, প্রতিটি ছন্দ, যেন এ দেশের প্রাণের আরেক ভাষ্য। সেইসব হারানো ভাষ্যের ভেতর গম্ভীরা এক অনন্য নাম। রাজশাহী অঞ্চলের বুক চিরে উঠে আসা গম্ভীরা গান শুধু সঙ্গীত নয়, সময়ের কথা বলা এক বিশেষ মাধ্যম, যেখানে হাসির ছলে বলা হয় সমাজের নানা গূঢ় সত্য, লোকজ বেদনা আর বিদ্রূপের নিখুঁত চিত্র। সময়ের আবর্তে আজ সেই গম্ভীরা হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই স্মৃতি, সেই অতীতের ধ্বনি আজও মনে বয়ে আনে অদ্ভুত এক হাহাকার।

 

গম্ভীরা শব্দের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে নানা মত। কেউ বলেন, ‘গম্ভীর’ শব্দ থেকেই এর জন্ম – যার অর্থ গভীর বা প্রকাণ্ড। আবার কেউ বলেন, গম্ভীর মুখ করে সমাজের সংকট নিয়ে গান গাওয়ার কারণেই নাম হয়েছে গম্ভীরা। মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চল গম্ভীরা গানের মূল আবাসভূমি। প্রাচীনকাল থেকে মঙ্গলকামনায়, সামাজিক অনুশাসনের বার্তা ছড়াতে, মানুষের মনের কথা রাজসভার দরবারে তুলতে গম্ভীরা ব্যবহৃত হতো। সময়ের পরিক্রমায় সেটি হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মুখপত্র। গান, ছড়া, কথোপকথন- সব মিলিয়ে এক অভিনব নাটকীয়তায় গম্ভীরা আজও বেঁচে আছে কিছু মানুষের স্মৃতিতে।

 

গম্ভীরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর উপস্থাপনভঙ্গি। সাধারণত দুইজন চরিত্র- নানা ও নাতি- দ্বিমুখী কথোপকথনের মাধ্যমে গম্ভীরা পরিবেশন করেন। নানা চরিত্রটি অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী, আর নাতি হলো কৌতূহলী ও প্রশ্নবাণে ভরা। নানা ব্যাখ্যা করেন, নাতি প্রশ্ন করে- এই দ্বন্দ্বের মাঝেই ফুটে ওঠে সমাজের চিত্র, মানুষের মনের কথা। মাঝে মাঝে চরিত্র বাড়তে পারে, বিষয়ভেদে পরিবেশনা হতে পারে আরও বড়, তবে মূল রূপ এই দ্বিপাক্ষিক আলাপেই আটকে আছে।

 

প্রচলিত বিশ্বাস, এই গম্ভীরা গানের বয়স প্রায় ৬০০ বছর। বাংলার সুলতানি আমলের রাজপ্রাসাদেও এর চর্চা ছিল। মুঘল আমলেও নাকি স্থানীয় পরগণার রাজা-মহারাজাদের মজলিশে গম্ভীরা পরিবেশিত হতো। তখন গম্ভীরা ছিল রাজকীয় বিনোদন, পরে গ্রামবাংলার মানুষ তাকে আপন করে নেয়। ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক পরব, নবান্ন উৎসবেও গম্ভীরা হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

এখানেই এসে পড়ে ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা। আজ থেকে প্রায় দশ-বারো বছর আগে, পেশাগত কাজে রাজশাহী গিয়েছিলাম। তখন আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতাম। দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলায় এক স্থানীয় মেলার মধ্যে গম্ভীরা গান দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আলোর ঝলকানি নেই, নেই বড় মঞ্চের আয়োজন-তবে সেই মাটির গন্ধমাখা পরিবেশ, সেই কথার স্রোত যেন হৃদয়ে শেকড় গেড়ে বসেছিল। তখনই প্রথম বুঝেছিলাম, কেবল গান নয়, গম্ভীরা হচ্ছে এক জীবন্ত ইতিহাস। চরিত্ররা সমাজের সমস্যা নিয়ে খুনসুটি করে কথা বলছে, আবার কোথায় যেন গভীর আর্তি- এক টুকরো মাটির রোদন। সেই মুহূর্ত আজও ভুলতে পারিনি।

 

কিন্তু তারপর? তারপর আর কখনো গম্ভীরা শোনা হয়নি। যদিও কাজের সূত্রে নানা এলাকায় যাওয়া হয়েছে, গম্ভীরা যেন কোনো হারানো সুরের মতো অধরা থেকে গেছে। এর একটা কারণ হয়তো আমার জন্মস্থান। আমি চাঁদপুরের মানুষ। চাঁদপুরে, কিংবা আশপাশের অঞ্চলে, গম্ভীরা তেমন প্রচলিত নয়। আর অন্য বড় কারণ হলো-গম্ভীরা সহ অনেক লোকগানেরই দিন দিন অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। শহুরে ব্যস্ততা, প্রযুক্তির অজস্র বিকল্প আর বাণিজ্যিক বিনোদনের দাপটে এই ধারা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

 

এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামে-গঞ্জে বাড়ি বাড়ি গম্ভীরার আসর বসতো। গাজনের সময়ে, চৈত্র সংক্রান্তির রাতে, মানুষের মুখে মুখে ফিরতো নানা গম্ভীরা দল। এখন সেই দৃশ্য প্রায় অতীত। ক’জন যুবকই বা আজ আর হাতে তাল, বাঁশি, ঢোল নিয়ে গম্ভীরা রপ্ত করতে চায়? লোকায়ত সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ কমে এসেছে, জীবনযাত্রার গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি মাটির সেই টান।

 

গম্ভীরা শুধু গান নয়, ছিল সচেতনতার হাতিয়ারও। ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি নিপীড়ন, কৃষকের দুর্দশা-সবকিছু নিয়ে গম্ভীরার ছন্দে প্রতিবাদ গাঁথা হতো। তখনকার শিল্পীরা ছিলেন জনতার কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার পরেও গম্ভীরার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষ তাদের সংকট, আশা-নিরাশার কথা বলতো। আজকের দিনে সেই শক্তিমান ধারাটা অনেকটাই বিবর্ণ। কিছু সংগঠন চেষ্টা করছে গম্ভীরাকে টিকিয়ে রাখতে, তবে তা বেশিরভাগ সময়ই সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। মূলধারার প্রচারে গম্ভীরা আজও অনুপস্থিত। মিডিয়ার চোখে সেটা যেন অনাকর্ষণীয় এক ঐতিহ্য মাত্র।

 

তবুও আশার আলো ফুরিয়ে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নাটোরের কিছু সংগঠন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আজও গম্ভীরার চর্চা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হচ্ছে, তরুণ শিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগ বাড়ে, যদি মিডিয়া একটু বেশি মনোযোগ দেয়, তবে হয়তো গম্ভীরা আবারও ফিরে পাবে তার হারানো কণ্ঠস্বর।

 

গম্ভীরার এই সংকটের পেছনে দায়ী একদিকে প্রযুক্তি ও সময়ের পরিবর্তন, আবার অন্যদিকে আমাদের নিজেদের অবহেলা। আমরা যারা মাটির সুর ভালোবাসি, তারা যদি একটিবার করে ভাবি-আমাদের আগামীর প্রজন্ম কি গম্ভীরার কথা জানবে? জানবে এই দেশজ সাংস্কৃতিক রত্নের কথা? যদি না জানে, তবে ইতিহাসের এই পাতাটি হয়তো চিরতরে মুছে যাবে।

 

গম্ভীরা আমাদের শুধু আনন্দ দেয় না, শেখায়। শেখায় হাসির ছলে কথার গভীরতা ধরতে, শেখায় সংকটের মধ্যেও প্রতিবাদী হতে, শেখায় সমাজের মুখপত্র হয়ে উঠতে। তাই গম্ভীরা শুধু মঞ্চের গান নয়, এটি হলো সময়ের রক্তমাখা আর্তনাদ, একটি জাতির শিকড়ের ভাষ্য। আমাদের দায়িত্ব এই শিকড়টিকে টিকিয়ে রাখা, বাঁচিয়ে রাখা।

 

আজ যখন কোনো মেলায়, কোনো গ্রামীণ আড্ডায় গম্ভীরার সুর ভেসে আসে দূর থেকে, মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনে হয়, হয়তো এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো কোনো গৃহস্থ বাড়ির উঠানে ঢোলের শব্দে বাঁধা পড়ে আছে সেই হারানো রাত্রির গান। এখনো কোনো নাতি প্রশ্ন করে, কোনো নানা উত্তর দেয়-সময়ের গম্ভীর ভাষ্যে।

 

তাই আসুন, নতুন করে ভালবাসি গম্ভীরাকে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে, সময়ের ধুলো ঝেড়ে, ফিরে যাই মাটির সেই ঘ্রাণে, সেই সুরের কাছে-যেখানে গম্ভীরা আজও বেঁচে আছে মৃদু কণ্ঠে, গোপন ভালোবাসায়।

 

লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী।

 

ছবি: সংগৃহিত।