হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত উপকরণ হার্টের রিং বা স্টেন্টের দাম নির্ধারণে বৈষম্য এবং তদারকির অভাবের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি তিনটি কোম্পানির ১০ ধরনের রিংয়ের দাম কমানো হলেও ইউরোপে তৈরি ২৮টি প্রতিষ্ঠানের রিংয়ের দাম এখনও অপরিবর্তিত। ফলে রোগীরা প্রত্যাশিতভাবে কম দামে রিং পাচ্ছেন না। একই সঙ্গে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল বাড়তি সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সরবরাহকারীরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, হৃদরোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত রিং ও সরঞ্জাম আমদানিনির্ভর। এসব চিকিৎসা উপকরণের দাম নির্ধারণ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন। দাম নির্ধারণে একটি জাতীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটিও রয়েছে। তাদের পরামর্শেই গত ৩ আগস্ট এক আদেশে তিন কোম্পানির স্টেন্টের দাম নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। স্টেন্টভেদে খুচরা মূল্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন এ দাম আগামী বুধবার থেকে কার্যকর হবে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চর্বি জমে বা অন্য কোনো কারণে হৃদযন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে। রক্ত চলাচল বৃদ্ধির জন্য এই রক্তনালির ভেতরে বিশেষ ধরনের ডিভাইস বা কল স্থাপন করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম করোনারি স্টেন্ট। হার্টের রিং নামে এটা বেশি পরিচিত।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে গড়ে ৩৫ হাজারের বেশি স্টেন্ট ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন গড়ে ৯৫ রোগীর হৃৎপিণ্ডে রিং বসানো হয়। দেশে ৩১টি প্রতিষ্ঠান স্টেন্ট আমদানি করে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের (অ্যাবট, বোস্টন সায়েন্টিফিক ও মেডট্রোনিক) দাম কমানো হলেও বাকি ২৮টির দাম অপরিবর্তিত।
এইচ আর এস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ডালিম হোসেন বলেন, একই ধরনের রিংয়ের ক্ষেত্রে একেকটি কোম্পানি ভিন্ন দাম নিচ্ছে। এতে ব্যবসায়িকভাবে আমরা ক্ষতির মুখে। সরকারের উচিত একটি সমন্বিত নীতিমালায় আসা। সব কোম্পানির দাম একসঙ্গে না কমালে ঔষধ প্রশাসন প্রশ্নের মুখে পড়বে। আবার নিয়ম না মেনে অনেক কোম্পানি নিজের মতো দাম নির্ধারণ করে রিং ও বেলুন বিক্রি করছে। এতে বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে স্টেন্টের দাম বাড়িয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। এতে রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েন। আমরা যৌক্তিকভাবেই দাম কমিয়েছি।
বাড়তি চার্জ নিচ্ছে হাসপাতাল
রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি ২০টির বেশি হাসপাতালে রোগীদের স্টেন্ট পরানো হয়। এর পর সবচেয়ে বেশি পরানো হয় চট্টগ্রাম শহরে। সেখানকার ১০টি হাসপাতালে হার্টে রিং পরানো চলছে বলে চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া সিলেট, দিনাজপুর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও কুমিল্লায় একটি বা দুটি করে হাসপাতালে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রোগীদের হার্টের দাম কমার সুফল পুরোপুরি দিচ্ছে না। তারা অন্য খাতে অতিরিক্ত চার্জ দিয়ে সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিচ্ছে। রোগীরা সঠিক তথ্য না জানার কারণে প্রকৃত মূল্যবৃদ্ধি/হ্রাস বুঝে উঠতে পারছেন না।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, স্টেন্টের নির্ধারিত মূল্যের সঙ্গে ৫ শতাংশের বেশি সার্ভিস চার্জ নেওয়া যাবে না। তবে একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, নামিদামি একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল সাত থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত চার্জ নিচ্ছে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।
একাধিক সরবরাহকারী বলছেন, কিছু হাসপাতাল অনৈতিকভাবে এই অতিরিক্ত চার্জ নিচ্ছে। এতে রোগীদের জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে। হাসপাতালগুলো যদি চার্জ কমায়, তাহলে রিং আরও কম দামে দেওয়া সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু স্টেন্টের দাম কমানো হলেও চিকিৎসা-সংক্রান্ত অন্য ব্যয় অপরিবর্তিত বা আরও বেড়ে গেছে। এতে করে মোট ব্যয় কমছে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ইউরোপীয় কোম্পানির স্টেন্টের দাম নির্ধারণে এ পর্যন্ত মাত্র একটি বৈঠক হয়েছে, তাও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়।
অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেন বলেন, তিন কোম্পানির মতো বাকিগুলোর দামও কমানো হবে। সেপ্টেম্বর না হলে অক্টোবরের মাঝামাঝি নির্ধারণ করা হবে। রোগীর সাধ্যের মধ্যে দাম আনতে আমরা চেষ্টা করছি। হাসপাতালগুলোকে বলা হয়েছে নির্ধারিত দামের বাইরে চার্জ না নিতে। বেসরকারি হাসপাতাল তদারকি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।
মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেন, প্রতি বছর নিয়ম করে স্টেন্টের দাম কমালে ব্যবসা চালানো কঠিন হবে। রোগীর জন্য দাম কমাতে হলে হাসপাতালের অন্যান্য চার্জও কমাতে হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি বা অপারেশন খরচ তো এক টাকাও কমানো হয়নি।
হাসপাতালের চার্জ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান সমকালকে বলেন, ব্যবসায়ীরা লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেহেতু এমন অভিযোগ উঠছে, বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখব।
প্রকাশক ও সম্পাদক: বিমল কুমার সরকার নির্বাহী সম্পাদক: তাসলিমুল হাসান সিয়াম বার্তা সম্পাদক: শামসুর রহমান হৃদয়। সম্পাদকীয় কার্যালয়: তুলশীঘাট (সাদুল্লাপুর রোড), গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা-৫৭০০
© All Rights Reserved © Kaler Chithi