
বিমল সরকার : কোনো কোনো বিদায় ইতিহাসের মতো, যা শেষ হয় না-মিশে থাকে আমাদের রক্তে, স্মৃতিতে, গানের সুরে,আর একটি জাতির আত্মপরিচয়ে। ফরিদা পারভীন চলে গেলেন।কিন্তু তিনি কি সত্যিই চলে গেলেন? শুধু শরীরটা থেমে গেল, আরো একবার বুঝিয়ে গেল-সত্যিকার শিল্পীরা চলে যান না, তাঁরা হয়ে ওঠেন “সুরতীর্থের জাগ্রত চেতনা।”- আর অমর হয়ে থাকবেন তিনি স্মৃতিতে যেমন করে সবাই চিরায়ত ইতিহাস হয়ে যায়। শনিবার রাতে যখন ঢাকার এক হাসপাতালে তাঁর নিঃশ্বাস স্তব্ধ হয়ে আসে,তখন যেন বাংলা সংগীতের অন্তর্লীন নদীও একটু থমকে দাঁড়ায়।রবিবার দুপুরে শহীদ মিনারের পাদদেশে যখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো সহস্র কণ্ঠ, অশ্রু আর কৃতজ্ঞতা,তখন মনে হচ্ছিলো-এই মানুষটি এককালে আমাদের আত্মার দরজা খুলে দিয়েছিলেন একটা গান দিয়ে: “মিলন হবে কত দিনে”- এখন যেন সেই মিলনের পাল্টা প্রশ্নই রেখে গেলেন আমাদের জন্য। আমি, একজন কালের প্রহরী, যখন এই বিদায়ের কথা লিখছি,তখন একধারে আমার সম্পাদকীয় দায়িত্ব,আর অন্যধারে আমার অন্তরের আঘাত- দুটোই বেদনায় লীন হয়ে গেছে। কারণ আমিও জানি-ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পী শতবর্ষে একবার আসে ।যে উক্তিটি যখন তাঁর স্বামী, বিখ্যাত বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম ভাঙা গলায় উচ্চারণ করলেন,তখন যেন সময় দাঁড়িয়ে গেল। তিনি বলেন- “কাজী নজরুল ইসলাম কি আর কোনোদিন হবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি আর আবার আসবে ? বিবেকানন্দ ! শরৎ চন্দ্র ! না ওরা কোনদিন আসে না তবে ফরিদা পারভীনের মতো গানের পাখিরা শতবর্ষে একবারই আসে।” এই কথার মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই।এটি ছিল এক জীবন্ত সত্যের আর্তনাদ।হাকিমের বাঁশি আর ফরিদার কণ্ঠ-যেভাবে যুগলভাবে উচ্চারণ করেছে সাধনার গূঢ় সুর,তা শুধুই সঙ্গীত নয়,তা ছিল প্রেমের আত্মিক স্তবক।আজ হাকিম বলছেন— “আমার বাঁশির সুরের কী হবে, জানি না।হয়তো ছেড়ে দিতে হবে, না হলে আরও বাজাতে হবে-যেন ওপারে সে তৃপ্তি পায়- আমার হাকিম তো এখনও বাজাচ্ছে।”এই কান্না যেন ব্যক্তিগত নয়,পুরো বাংলার, পুরো সাধনার এক নিঃশব্দ বিলাপ। ফরিদা পারভীনের গানে আমরা পেয়েছিলামভবের গান, প্রীতির গান, ঈশ্বর-অন্বেষার গান।তাঁর গলায় লালনের দর্শন যেমন ছিল,তেমনি ছিল এক অন্তর্জাগতিক শক্তির প্রকাশ।তিনি প্রমাণ করে গেছেন- লালনের গান শুধু আখড়ায় নয়,তার স্থান থাকতে পারে প্যারিসের মঞ্চেও,মেট্রোপলিটন শিল্পসভার আলোয়ও।তাঁর শেষ যাত্রা তাই হয়েছিলো যেন দুই জগতের মিলন।প্রথমে শহীদ মিনারে সম্মান,তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাজা,এরপর সেই কুষ্টিয়া-যেখানে শুরু হয়েছিলো তাঁর গান,সেই মাটিতেই হলো তাঁর পরিণাম।যেখানে একদিন তিনি বলেছিলেন- “আমি গান গাই না, আমি গানের ভেতর থাকি।” আজ সে গানের ভেতর থেকেই তিনি রয়ে গেলেন। রয়ে গেলেন আমাদের হৃদয়ের অন্তরালে, চেতনার পবিত্র প্রাঙ্গণে।আজ এই প্রস্থান এক বিষণ্ণ সমাপ্তি নয়-বরং এটি এক শ্রদ্ধার জাগরণ। আজকের এই দিনে, দৈনিক কালের চিঠি তাঁকে শ্রদ্ধা জানায়, শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, একজন কণ্ঠসাধক, একজন বাউল-প্রাণ, একজন মানব-সেতুবন্ধন হিসেবে। তাঁর গান যতদিন বাজবে, তাঁর নাম ততদিন অমলিন থাকবে। আমরা জানি, তাঁকে আর ফিরে পাবো না, তবে তাঁর গান ফিরিয়ে আনবে আমাদের নিজেদের কাছে- আত্মার কাছে, মানুষের কাছে, আলোর কাছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক: বিমল কুমার সরকার নির্বাহী সম্পাদক: তাসলিমুল হাসান সিয়াম বার্তা সম্পাদক: শামসুর রহমান হৃদয়। সম্পাদকীয় কার্যালয়: তুলশীঘাট (সাদুল্লাপুর রোড), গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা-৫৭০০
© All Rights Reserved © Kaler Chithi