তাসলিমুল হাসান সিয়াম: বর্তমান সমাজে ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এটি শুধু একজন ব্যক্তির মর্যাদা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না, বরং তার জীবনকেও চিরতরে বদলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার তরুণী যথাযথ বিচার বা সহানুভূতি না পেয়ে চরম হতাশা ও অপমানের ভার সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য ব্যক্তির পাশাপাশি বড় দায়ভার বর্তায় রাষ্ট্রের উপর।
রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো তার নাগরিকের জীবন, সম্মান এবং নিরাপত্তা রক্ষা করা। যখন একটি তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়, তখন তার প্রাথমিক চাহিদা হয় নিরাপত্তা, বিচার এবং পুনর্বাসন। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীরা বিচারপ্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়, বহু ক্ষেত্রে আবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। থানায় অভিযোগ করতে গেলে নিপীড়িতকেই উল্টো অপমানিত হতে হয়, তদন্তে গাফিলতি দেখা যায়, আর বিচারপ্রক্রিয়ায় দেরি যেন একটি স্বাভাবিক বিষয়। পাশাপাশি, সামাজিকভাবে ভুক্তভোগীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, তা তার মনোবলে মারাত্মক আঘাত হানে।
এই পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবে রাষ্ট্রের কাঠামোগত ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। যদি রাষ্ট্র যথাযথভাবে দ্রুত বিচার, মানসিক সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো, তাহলে অনেক তরুণী হয়তো নতুন করে জীবন শুরু করতে পারত। রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন এবং সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত ব্যর্থতার কারণেই এমন মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম হয়।
তাই ধর্ষণের শিকার তরুণীর আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয় — এটি একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যর্থতার করুণ চিত্র। এই দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। বরং রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে, এবং ভুক্তভোগীদের জন্য সহানুভূতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই প্রকৃত অর্থে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে একজন তরুণী অপমানের বোঝা নয়, সাহস ও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার সুযোগ পাবে।
সম্প্রতি পটুয়াখালীর দুমকিতে দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এই কিশোরীর বাবা প্রাণ হারান। পটুয়াখালীর দুমকিতে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার সময় গত মার্চে ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি। পুলিশি তথ্য থেকে জানা গেছে ,বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এই কিশোরীর বাবা প্রাণ হারান। পটুয়াখালীর দুমকিতে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাওয়ার সময় গত মার্চে ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি।
দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় গত ২০ মার্চ দুজনকে আসামি করে মামলা করেন কিশোরী। আসামিদের একজন জনতা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র শাকিব মুন্সি (১৯) এবং অন্যজন স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র (১৭)।
কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ঘটনার এক মাসে রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার পাননি ঐ কিশোরী । উল্টো তাকে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে। দেশের অসুস্থ মানসিকতার রাজনীতিবিদরা তাকে নিয়ে রাজনীতি করে রীতিমতো উপহাস করেছে । শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয় এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করছে।
এখন আসুন জেনে নেই রাষ্ট্র যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে নিপীড়নের শিকার নারীর জীবন বিপন্ন করতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে।
ধর্ষিতাকে রাষ্ট্র যেভাবে হত্যা করে :
ধর্ষণ একটি শারীরিক অপরাধ — এ কথা আমরা জানি। কিন্তু ধর্ষণের পর যে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং মানসিক পীড়নের অসহনীয় যাত্রা শুরু হয়, তার শেষ হয় ভিকটিমের নিঃশব্দ মৃত্যুতে। এই মৃত্যু কখনো আত্মহননের রূপ নেয়, কখনো সারা জীবনের এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়, যেখানে সমাজের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি নিয়ম, এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিটি কাঠামো তাকে ধীরে ধীরে হত্যা করে। ধর্ষিতার মৃত্যু তাই কেবল ধর্ষকের হাতে নয় — রাষ্ট্রের নীরবতা, অবহেলা, এবং বিচারহীনতার মধ্য দিয়েও ঘটে।
বিচারহীনতার অন্ধকার:
ধর্ষণের পর ভিকটিম যদি সাহস করে থানায় যায়, সেখানে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় মামলা নেয়ার অনীহা। পুলিশি ব্যবস্থার জটিলতা, প্রশ্নবানে জর্জরিত হওয়া, এমনকি অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ — সব মিলে ভিকটিমকে দ্বিতীয়বার ধর্ষিত করে। তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর লেগে যায়, বহু ভিকটিম জীবদ্দশায় ন্যায়বিচার দেখে না।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল তার পাশে দাঁড়ানো, তাকে সম্মান দেয়া। কিন্তু ন্যায়বিচারের পরিবর্তে যদি দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি এবং অবহেলা উপহার দেওয়া হয়, তাহলে ভিকটিম আর কাদের ভরসা করবে? এই বিচারহীনতা তার আত্মবিশ্বাসের মৃত্যু ঘটায়, তার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে।
সমাজের নৃশংস বিচারের আসর:
ধর্ষণ যখন ঘটে, তখন অপরাধী নয়, বরং ভিকটিমই হয়ে ওঠে প্রশ্নবিদ্ধ। "কী পোশাক পরেছিল?" "কেন রাতে বের হয়েছিল?" "তার চরিত্র কেমন?" — এই প্রশ্নগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উদাসীনতা প্রশ্রয় পেয়ে সমাজের প্রতিটি কোণ থেকে ছুটে আসে। ধর্ষণের পর সমাজ যখন ভিকটিমকে দোষারোপ করে, তাকে একঘরে করে, তখন রাষ্ট্রের নীরবতা সেই নির্যাতনকে বৈধতা দেয়।
রাষ্ট্র যদি চাইত, তাহলে সচেতনতামূলক প্রচারণা, আইনি সংস্কার, ও সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে — এবং এই ব্যর্থতা ভিকটিমের প্রতিদিনের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
মিডিয়ার শিকার:
মিডিয়া, যা হওয়া উচিত ছিল ভিকটিমের কণ্ঠস্বর, অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায় তার ব্যক্তিগত জীবন ভেঙে ফেলার হাতিয়ার। অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিচয় ফাঁস হয়, তার জীবন খণ্ডচিত্রের মতো জনসম্মুখে মেলে ধরা হয়। হেডলাইনের ব্যবসায় ভিকটিমের মানবিকতা হারিয়ে যায়, সে হয়ে ওঠে কেবল একটি ‘সংবাদ’।
রাষ্ট্রের উচিত ছিল এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ঠেকানো। কিন্তু যখন রাষ্ট্র তা করে না, তখন ভিকটিমের আত্মসম্মান, মর্যাদা — সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় মিডিয়ার হাত ধরে।
মনস্তাত্ত্বিক মৃত্যু:
সব শেষে, ধর্ষণের শারীরিক ক্ষত সেরে উঠলেও, মানসিক ক্ষত কখনোই সারতে পারে না। বিচারহীনতা, সামাজিক অবজ্ঞা, নিরাপত্তাহীনতা, আত্মীয়স্বজনের অবহেলা — এই সবকিছু মিলে ভিকটিমের মনের মধ্যে প্রতিদিন এক নতুন মৃত্যু ঘটায়। একসময় এই মৃত্যু তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, অথবা জীবন্ত এক শব বানিয়ে ফেলে।
কখনো কখনো হুমকি-ধমকিতে আক্রান্ত হয়ে, অথবা চূড়ান্ত হতাশায় ভিকটিম আত্মহত্যা করে।
এটাই চূড়ান্ত হত্যা — যেখানে ধর্ষিতার জীবনের শেষ প্রদীপটিও নিভে যায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতায়।
লেখক: তাসলিমুল হাসান সিয়াম
নির্বাহী সম্পাদক
কালের চিঠি
প্রকাশক ও সম্পাদক: বিমল কুমার সরকার নির্বাহী সম্পাদক: তাসলিমুল হাসান সিয়াম বার্তা সম্পাদক: শামসুর রহমান হৃদয়। সম্পাদকীয় কার্যালয়: তুলশীঘাট (সাদুল্লাপুর রোড), গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা-৫৭০০
© All Rights Reserved © Kaler Chithi