গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার নির্ধারণের বিদ্যমান ব্যবস্থা ‘স্মার্ট’ প্রথা উঠে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকের পর এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। ওই দিন ঋণের শর্ত যাচাই বিষয়ে ঢাকা সফররত আইএমএফ টিমের বৈঠক শেষ হবে। পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হলে সুদহার আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রতি মাসে সুদহার বাড়ছে। গত এপ্রিলে সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগের মাস মার্চের স্মার্ট ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৯ শতাংশ। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পরিপালনের জন্য গত জুলাই থেকে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যবস্থায় স্মার্টের সঙ্গে নির্ধারিত মার্জিন যোগ করে সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই থেকে প্রতি মাসের শেষ কর্মদিবসে স্মার্ট ঘোষণা করে। তবে গত এপ্রিলের স্মার্ট কত আনুষ্ঠানিকভাবে তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
গতকাল রোববার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্মার্ট প্রথা তুলে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, এখন যে সুদহার রয়েছে তা প্রায় বাজারভিত্তিক। আগামীতে স্মার্ট তুলে দিলেও সুদহার তেমন বাড়বে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির অন্যতম শর্ত মেনে রিজার্ভ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সংস্থাটির সামনে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে মোটা দাগে সুদহার বাজারভিত্তিক এবং বিনিময় হার আরও নমনীয় করার পরামর্শ রয়েছে সংস্থাটির। এ নিয়ে যেন তাদের প্রধান কার্যালয়ের প্রশ্ন না থাকে, সে জন্য দ্রুততম সময়ে সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি কার্যকর হলে ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করবে। যদিও আগের মতো ঋণ ও আমানতের মধ্যে সুদহারের সর্বোচ্চ ব্যবধানের একটি সীমা দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন একটি ব্যবস্থা চালু হবে। এর মাধ্যমে এখনকার চেয়ে বিনিময় হার আরও নমনীয় করা হবে। যদিও তা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে না। সে ক্ষেত্রে ডলারের একটি মধ্যম দর ঠিক করে দেওয়া হবে। তার সঙ্গে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ওঠানামার শতাংশ ঠিক করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হলে সেটি ভালো হবে। শুরুতে হয়তো সুদহার সামান্য বাড়বে। তবে দ্রুততম সময়ে তা স্থিতিশীল হয়ে আসবে। তিনি বলেন, কেউ চাইলেই বাজারের বাইরে গিয়ে হঠাৎ কিছু করতে পারবে, তেমন না। বরং সুদহার কেমন হবে তা নির্ধারিত হবে আমানতের সুদ এবং ব্যাংকের দক্ষতার ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আগামী ৮ মে সুদহারের নতুন ব্যবস্থার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। তবে একবারে যেন সুদহার অনেক না বাড়ে, সেজন্য কী করা যায় ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, ট্রেজারি বিলে টাকা রেখে এখন ১১ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেজারি বন্ডের সুদহার উঠেছে আরও বেশি। ফলে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণে কেমন সুদ নেবে তা তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পরও দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিতি রেপোর সুদ বাড়িয়ে চলতি মুদ্রানীতিতে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া গত অর্থবছর সরকারের ঋণ চাহিদার বেশির ভাগই সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া হলেও এখন পুরোটাই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে। সব মিলিয়ে মুদ্রা সংকোচনের ফলে বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। এতে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার দ্রুত বাড়ছে। যার প্রভাবে ঋণের সুদও বাড়ছে। আমানতকারীরাও এখন ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদ পাচ্ছেন।
কালের চিঠি / কনক